বিহঙ্গী বিশ্বাস
‘আরে ছো ছো, ক্যায়া শরম কি বাত….. ভদ্দর ঘরকা লড়কি ভাগে, ডেরাইভার কা সাথ’—‘ছদ্মবেশী’ (১৯৭১) ছবির সেই সুপারহিট গানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল ‘শরম’ অর্থাৎ লজ্জার। ভদ্রঘরের মেয়ে (‘ভদ্দর ঘরকা লড়কি’)-র ‘ডেরাইভার’ অর্থাৎ ড্রাইভার, মানে গাড়িচালকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টা সেই যুগে ‘শরম কি বাত’ বা লজ্জার বলে মনে করা হত। কিন্তু অর্ধশতকেরও বেশি (৫৩ বছর) সময় পর এই ২০২৪-এও কি সেই ‘শরম কি বাত’-এর চরিত্রে বদল এসেছে কোনও? এলেও কতটা বদলেছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী? অভিনেতা তথা জন-প্রতিনিধি কাঞ্চন মল্লিকের তৃতীয় বিয়ের রিসেপশন পার্টির ভেন্য়ুর বাইরে রাখা একটি নিষেধবার্তা নিয়ে যে বিতর্ক, তাতে প্রশ্ন উঠেছে: ড্রাইভার সম্প্রদায় কি লজ্জার বিষয়? সোশ্যাল মিডিয়ায় গর্জে উঠেছে নেটিজ়েনদের একটা বড় অংশ, কারণ ৬ মার্চ, বুধবার ওই ভেন্যুর বাইরে রাখা ছিল একটি প্ল্যাকার্ড: “Please! Press And Personal Securities And Drivers Are Not Allowed. Inconvenience Is Regretted”।
রিসেপশনের স্থান মধ্য কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিটের এক বহু পুরনো হোটেল ‘গ্যালেরিয়া ১৯১০’। তারই দরজার বড় বড় করে লেখা ছিল ওই নিষেধবার্তা, “Please! Press And Personal Securities And Drivers Are Not Allowed. Inconvenience Is Regretted”, যার বাংলা অনুবাদ করলে হয়, “প্লিজ়! সংবাদমাধ্যম, ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী এবং গাড়ির চালকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ…।” উত্তরপাড়ার বিধায়ক জন-প্রতিনিধি কাঞ্চন মল্লিকের রিসেপশনের ভেন্যুতে রাখা এই প্ল্যাকার্ডের পিছনে কাজ করছে এক ঘোরতর শ্রেণী বৈষম্যমূলক ভাবনা, নেটিজ়েনদের অভিযোগ এমনটাই। যদিও TV9 বাংলার কাছে কাঞ্চন দাবি করেছেন, তিনি বিন্দুবিসর্গও জানেন না এই নিষেধবার্তার কথা। বলেছেন, “আমরা বলেছিলাম, আপনারা (এক্ষেত্রে ভেন্যু কর্তৃপক্ষ) দয়া করে বলবেন, যাঁরা-যাঁরা আসছেন আমন্ত্রিতদের সঙ্গে, তাঁরা ফার্স্ট ফ্লোরে অপেক্ষা করবেন, বাকিরা উঠে আসবেন। গেস্ট লিস্টেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল ভেন্যুতে। এবং তাঁরা (এক্ষেত্রে ভেন্যু কর্তৃপক্ষ) সেটা বুঝে কী লিখেছেন, আমি জানিই না।” তবে এহেন দাবির পরও ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন কাঞ্চন, “তা-ও বলছি, যদি কারও খারাপ লেগে থাকে, আমি তাঁদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।”
কিন্তু কাঞ্চন যে দাবিই করুন না কেন, ‘গ্যালেরিয়া ১৯১০’ কর্তৃপক্ষ তৃণমূল উত্তরপাড়ার বিধায়কের দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন ফুৎকারে। TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় ‘গ্যালেরিয়া ১৯১০’-এর ব্যাঙ্কোয়েট ম্যানেজার অভিজিৎ আচার্যের সঙ্গে। প্রশ্ন করা হয়, ‘এই নিষেধবার্তার কথা কি জানতেন কাঞ্চন-শ্রীময়ী?’ ব্যাঙ্কোয়েট ম্যানেজারের উত্তর, “আমি জানি না হোস্ট কেন এমন বলছেন।” আরও এক ধাপ এগিয়ে তাঁর প্রশ্ন, “আমাদের যদি নির্দেশ না-দেওয়া হয়, আমরা কী লিখতে পারি এরকম? ২৫০ জনের আসন ছিল। গেস্ট লিস্ট ছিল ২৪৭। আমাদের বলা হয়, গেস্ট লিস্টের বাইরে কাউকে না ঢোকাতে। তবে গেটের বাইরে যে লেখা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই লেখার দায়ভার আমাদের নয়।” ‘হোস্ট’ (এক্ষেত্রে কাঞ্চন মল্লিক) যে এ দিকে সাফাই দিয়েই রেখেছেন, “তাঁরা (ভেন্যু কর্তৃপক্ষ) কী লিখেছেন, আমি জানিই না।”
তাহলে কি ‘গ্যালেরিয়া ১৯১০’-ই দায়ী? অভিজিতের দাবি, “আজও আমাদের অনুষ্ঠান হয়েছে। দেখে যান, এই সব কিছু লেখা আছে কি না? হোস্ট (এক্ষেত্রে কাঞ্চন মল্লিক) যা বলেছেন, আমরা ঠিক তাই-ই লিখেছি।” আরও সংযোজন ব্যাঙ্কোয়েট ম্যানেজারের, “কাল যদি কোনও চালক অথবা নিরাপত্তারক্ষী ঢোকার চেষ্টাও করতেন, আমরা (গ্যালেরিয়া) কখনওই তাঁদের অপমান করতাম না। সমাজের কোনও শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন আমরা করি না। আমাদের হল ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। যা নির্দেশ ছিল, তাই-ই পালন করেছি। লেখার বয়ানও হোস্টের থেকেই এসেছে।”
একজনের ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলে আরেকজনের ঘাড়ে দায় চাপানো? এমনটাই কি হয়েছে এই ঘটনায়? যদিও ড্রাইভার ও রেস্তোরাঁ বিতর্কের সাক্ষী আগেও হয়েছে এই শহর। ২০১৬ সাল, চালকের সঙ্গে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ ‘মোক্যাম্বো’য় খেতে গিয়ে চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছিলেন এক মহিলা। চালকের পোশাক সেই রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার উপযোগী নয়, এই ‘অভিযোগ’-এ সে দিন ‘অতিথি’ চালককে ঢুকতে দেয়নি সেই বিলাসবহুল, তথাকথিত শৌখিন রেস্তোরাঁ। পার্কস্ট্রিটের রাস্তায় হয়েছিল বিক্ষোভও। ২০১৬-র পর ২০২৪… সোশ্যাল মিডিয়ায় গর্জে উঠেছেন ডিজিটাল নেটিভের দল। তবু যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে–চলা ৫৩ বছর আগের সেই গানটা থামতেই চাইছে না: ‘আরে ছো ছো, ক্যায়া শরম কি বাত…