জয়িতা চন্দ্র
কৌশানী মুখোপাধ্যায়—রোম্যান্টিক গান অথবা হিরোর সঙ্গে চুটিয়ে নাচ, গ্ল্যামারাস চরিত্র নয়তো ফ্যামিলি ড্রামা। এতদিন যেন এই সংজ্ঞাতেই আটকে ছিলেন। ‘অভিনয়টা ঠিক আসে না ওর (কৌশানী)…’, নিন্দুকদের মুখে-মুখে ফেরা এই কটাক্ষের এবার যেন মোক্ষম জবাব দিলেন কৌশানী। কেরিয়ারের দশম বছরের মাথায় এবার অন্য স্বাদের চরিত্র উপহার দিয়ে যেন সপাটে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন অভিনেত্রী। ‘আবার প্রলয়’ সিরিজ-এ মণির চরিত্রে অভিনয় করে ইন্ডাস্ট্রির অন্ধ বিশ্বাস ভাঙলেন তিনি। রাতারাতি হয়ে উঠলেন টলিপাড়ার চর্চিত মুখ। না—পরিচিতির নিরিখে কৌশানীর জনপ্রিয়তা কম নয়, তবে অভিনয়ের দাপটে কৌশানী এই প্রথম ১০ গোলে চুপ করালেন নিন্দুকদের। TV9 বাংলার কথা বলল কৌশানী, থুড়ি মণির, সঙ্গে।
কৌশানীর গায়ে কমার্শিয়াল অভিনেত্রীর ট্যাগ—সেই কৌশানী মণি?
প্রথম দিন থেকে এখানেই আমার আপত্তি। এই যে আপনারা ভাবতেন, কৌশানী মানেই গ্ল্যামার, কৌশানী মানেই কমার্শিয়াল হিরোইন, এই যে মানুষের মনে ধারণাটা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, এটাতেই আমার সমস্যা। আমি যে শুধু এই জ্যঁরেই স্বচ্ছন্দ্য, এটা কখনওই নয়। সমস্যাটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির। এটা আমি একাধিকবার বলেওছি। আমাদের টাইপকাস্ট করে দেওয়া হচ্ছে। মুম্বইয়ে দেখি অন্য ছবি। যেখানে ‘রকি অউর রানি’তেও আলিয়া ভাট’, তিনিই আবার ‘গাঙ্গুবাঈ’। এখানে সেই চলটা নেই। একজন কমার্শিয়াল অভিনেত্রীকে নিয়ে এই ঝুঁকি বাংলা ইন্ডাস্ট্রি নেয় না।
পর্দায় কোনও চরিত্র দেখে আক্ষেপ হয়? ‘এটা তো আমিও করতে পারতাম…’
এমন অনেক চরিত্র রয়েছে, যা দেখে আমার মনে হয়—এতে এমন কী ছিল যে, আমি করতে পারতাম না। অথবা একটা সুযোগ অন্তত দেওয়া গেল না? আমার মনে হয় ঠিক এই সুযোগটা দেয়নি বলেই মানুষ আমায় এভাবে চিনেছে। আমি অভিনয় ঠিক করে করি না, আমি তেমন জোরাল পারফরম্যান্স দিতে পারি না… কীভাবে পারব? আমি তো এগুলো দেখানোর মতো চরিত্রই পাইনি। আর যেখানে আমি চরিত্র পেয়েছি, সুযোগ পেয়েছি, দেখিয়েছি। ‘শুভ বিজয়া’তে কাজ করেছি, সেখানে কাজের অনেক সুযোগ ছিল। ‘আবার প্রলয়’-এর ক্ষেত্রেও তাই। এক্ষেত্রে আমি রাজদাকে (রাজ চক্রবর্তী, সিরিজের পরিচালক) অনেক ধন্যবাদ দেব।
প্রথম সুযোগও রাজের থেকে, ছকভাঙা ছবির সুযোগও রাজের থেকেই…
এটার জন্য আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। প্রায় ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে রাজদার হাত ধরেই ছবির জগতে আসা। আবার এতবছর পর এই সাহসী চরিত্রের জন্য তিনিই আমার ওপর আস্থা রাখলেন। অন্তত আমি নিজেকে প্রমাণ করার একটা সুযোগ পেলাম। মজার বিষয়, এটা আমাদের দু’জনের একসঙ্গে ওয়েব সিরিজ ডেবিউ। আমি বারবার বলতে পারি আমায় দমিয়ে রাখা হয়েছিল, আমায় সুযোগ দেওয়া হয়নি। রাজদাকে বলেছিলাম, ‘আমি তোমার মাথা হেঁট হতে দেব না। তোমার যা-যা আমাকে দিয়ে করানোর, চরিত্রের স্বার্থে, আমি সবটার জন্যই প্রস্তুত।’ করেছিও।
রাজের পরিচিত হওয়ার কারণে কি কিছু সুযোগ-সুবিধে মেলে?
একেবারেই নয়। একদম নয়। ফ্লোরে রাজদা অন্য মানুষ। তখন তিনি কাউকে চেনেন না। চেনেন শুধু নিজের টিমকে, নিজের কাস্টকে। এটাই শেষ পরিচয়। এটা একটা জীবন-মৃত্যু পরিস্থিতি। যদি তোমায় বাইক চালাতে হয়, তো হবে। যদি তোমায় ফাইট করতে হয়, হবে। দেখুন একটা কাজ কতটা হিট হবে, তা তো আগে থেকে বলা যায় না, তবে আমি আন্দাজ করেছিলাম ‘আবার প্রলয়’ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করবে। এটাই আমার একমাত্র সুযোগ ছিল, সেটা আমি জানতাম। হয় আমি ভাল করব, আজ যেটা হচ্ছে, সেটা আশা করেছিলাম। আর নয়তো নিন্দুকেরা বলবে বলে বসেই আছে, ‘কৌশানী তো এমন চরিত্রের জন্য নয়…।’ এই জন্যই আমি আমার ২০০০ শতাংশ উজাড় করে দিয়েছিলাম।
কৌশানীকে চিনতে টলিপাড়ার ১০ বছর লাগল?
লাগল…। তাই-ই তো লাগল। আমার আক্ষেপ হয়, আরও আগে কেন এমন একটা চরিত্র কেউ আমায় দিলেন না। তাহলে হয়তো আরও অনেক অন্যস্বাদের কাজ করতে পারতাম।
আপনার কি মনে হয় না, প্রাথমিকভাবে আপনারও চরিত্র বাছাই করার ক্ষেত্রে আরও একটু সিলেক্টিভ হওয়া উচিত ছিল?
যে কোনও অভিনেতা বা শিল্পীরই একটা লড়াই থাকে, তাঁকে তো টিকে থাকতে হবে। তাঁকে তো চর্চায় থাকতে হবে, লাইমলাইটে থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে নিজের একটা পরিচিতি তো তৈরি করতে হবে। ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড’ বৈশিষ্ট্য়ের ইন্ডাস্ট্রি এটা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সময় এটা বলা যায় না যে, আমি এটা করব না অথবা আমি এটা পছন্দ করছি না। বাছাই করার জায়গায় তখন থাকা যায় না। তখন পরিচিতি তৈরির জন্য আমার যা-যা করার ছিল, আমি করেছি। তবে পরবর্তীতে আমি বাছাই করার চেষ্টা করি, আমি দেবের সঙ্গে কাজ করেছি, জিতের সঙ্গে কাজ করেছি। ভাল চরিত্র করতে গেলে, ভাল চরিত্রটার প্রস্তাবটাও তো আসতে হবে… তাই না!
(অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত, অভিনেত্রীর বিশেষ বন্ধু, সহকর্মী) ‘বনির অভিনেত্রী’, এই ট্যাগটাই তো একটা সময় আপনার পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায়…এটা কাটিয়ে ওঠাটাও তো লড়াই…
‘বনির অভিনেত্রী’ বললেন বলে বলছি, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এখনও বর্তমান। আমরা যতই বলি ‘মহিলারা অনেক এগিয়ে গিয়েছি’, ‘আমরা পুরুষদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলছি’, আমি বলব, ‘ভুল, মেয়েরা এখনও অনেক পিছিয়ে।’ এটাই প্রমাণ করে যে, আজও এক অভিনেতার নামে ছবি মুক্তি পায়। অভিনেত্রীর কদর আজও সমানে সমানে আসেনি। বনিকে এমন কেন বলা হয় না বলুন তো ‘কৌশানীর অভিনেতা’? এটা সমাজের সমস্যা। বিতর্ক এড়িয়ে এক্ষেত্রে আসল যুক্তি দিতে পারি, আমি বা আমরা কিন্তু প্রযোজক নই। আমরা পরিচালকও নই। আমাদের কাস্ট করা হয়। ওর সঙ্গে আমার অধিকাংশ ছবি। এবার যাঁরা ছবি বানাচ্ছেন, এই প্রশ্নটা তো তাঁদের করা উচিত, বারবার এই জুটি কেন? হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে দর্শক আমাদের গ্রহণ করছে, আমাদের একসঙ্গে দেখতে চাইছে। এই প্রশ্ন আমিও করেছি। এখন অনেক ক্ষেত্রে দেখবেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে, সব ধরণের চরিত্রেই রাজি হয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আপনি দেখবেন, আমি অনেক ছবিতেই নেই। তার মানে এই নয় যে, আমার কাছে প্রস্তাবগুলো ছিল না। মানুষ তো ওপরটাই দেখে। ভিতরটা বোঝার ক্ষমতা ক’জনের থাকে?
বনির নাম যখন বিতর্কে জড়ায়, তখন তো আপনার নামও উঠে এসেছিল…
বনি না আমার সংসার চালায়, না আমাকে তৈরি করেছে। আমিও বনিকে তৈরি করিনি। আমারটা আমায়, আর ওরটা ওকেই করতে হবে। আমরা একে অন্যের বিপদে পাশে থাকতে পারি, পরামর্শ করতে পারি। যখন বনির জীবনে একটা সমস্যা দেখা দেয়, তখন কিন্তু আমার নামটা সত্যি জড়িয়ে যায়। সেই সময় আমার মাথায় দু’টো বিষয় কাজ করছিল। এক, আমার বন্ধুর বিপদে পাশে থাকা। দুই, আমার নিজের জায়গাটা পরিষ্কার রাখা। তবে কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ট্রোল করেই যাবেন। যাঁরা বলেই যাবেন, আমি এই নিয়ে আর ভাবি না।
ট্রোল পেরিয়ে প্রশংসা…
আমি সত্যি বলতে ট্রোলারদের থেকে কিছু আশা করি না। কারণ যাঁরা ভাল বলতে পারেন না বা বলতে কষ্ট হয়, তাঁরা ভাল কাজ দেখলেও বুকে পাথর চাপা দিয়ে একটা কিন্তু খোঁজার চেষ্টা করবেনই। আমায় রোস্ট করে যদি কারও পেট চলে, তবে আপত্তি কোথায়?
অনেক অভিনেত্রীই তো রয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। তবুও এক-দু’জনের ঝুলিতেই ছবি… কিছু বলবেন?
এটা নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। এটা একটা ওপেন সিক্রেট। আমি একটা কথা বিশ্বাস করি, না আমি এই প্রজেক্টগুলোতে বিনিয়োগ করছি। না আমার গল্প, আমার কোনও সংযোগ নেই। তাই আমার এই বিষয় অভিযোগ থাকারও কথা নয়। এই ১০ বছরে তো আমার অনেক আক্ষেপই হয়েছে। খালি মনে হতো, এটাতে তো আমায় নিতে পারত…। তবে এটাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেওয়াটা ভুল। নয়তো এত স্টার টিকে আছেন কীভাবে। রাজদা তো আমায় সুযোগ দিলেন, এখন অনেক নতুন মুখকে নিয়ে তিনি কাজ করছেন। কমার্শিয়াল কৌশানীর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল… হয়তো আছেও। এই মণির মতো চরিত্ররাই আমার জবাব বলে আমি বিশ্বাস করি।