AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

এক বাঙালির কাছে চল্লিশটা গাড়ি নিয়ে এলেন রামোজি রাও, তারপর ইতিহাস…

Nitish Roy's Tribute to Ramoji Rao: রামোজি ফিল্ম সিটি তৈরি করার জন্য এক বাঙালির বুদ্ধির উপরই ভরসা করেছিলেন সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি রামোজি রাও। সেই বাঙালির নাম নীতীশ রায়। রামোজির সঙ্গে বহু স্মৃতি নীতীশের। ফিল্ম সিটি তৈরির ইতিহাস বলতে-বলতে রামোজি রাওয়ের এক চিত্র তুলে ধরলেন এই বাঙালি আর্ট ডিরেক্টর। কত যে মণিমুক্ত... সব তুলে ধরল TV9 বাংলা ডিজিটাল।

এক বাঙালির কাছে চল্লিশটা গাড়ি নিয়ে এলেন রামোজি রাও, তারপর ইতিহাস...
নীতীশ রায়।
| Updated on: Jun 15, 2024 | 9:15 PM
Share

কৃত্রিম এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, সমুদ্র, লন্ডন-প্যারিসের মতো বিদেশি পথঘাট-বাড়ি–শুটিংয়ের জন্য আসল লোকেশনে না গিয়ে রামোজি ফিল্ম সিটিতে গেলেই সবটা এক ছাদের তলায় পেয়ে যান ছবির নির্মাতারা। হায়দরাবাদে অবস্থিত সেই ফিল্ম সিটির নির্মাতা রামোজি রাও প্রয়াত হয়েছেন ৮ জুন, ২০২৪ (শনিবার)। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ আর্ট ডিরেক্টর নীতীশ রায়। রামোজি রাওয়ের ড্রিম প্রজেক্টকে বাস্তবরূপ দিয়েছেন এই বঙ্গসন্তান। তাঁর উপর আস্থা রেখেছিলেন খোদ রামোজি রাও। রামোজির প্রয়াণে ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়েছেন নীতীশ। কলম ধরলেন TV9 বাংলা ডিজিটালে।

৪০টা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন রামোজি রাও

এ কোন সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন আমাকে। সব যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি এখন। সালটা ছিল ১৯৯২। আমি তখন মুম্বইয়ের ছবিতে আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করি। আমিই ছিলাম মুম্বইয়ের একনম্বর আর্ট ডিরেক্টর। হায়দরাবাদের পদ্মনায়া স্টুডিয়োতে আমি সেট তৈরি করেছিলাম। ছবিটা তৈরি করছিলেন ডেভিড ধাওয়ান। ছবির নাম ‘লোফার’। পদ্মনায়া স্টুডিয়োতে সেট লাগানোর পর সারা হায়দরাবাদে হইচই পড়ে গিয়েছিল। সবাই বলছিলেন, দারুণ ভাল সেট লেগেছে। রাস্তা-ঘাট সব তৈরি করা হয়েছে। সব কিছু দেখে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। রামোজি রাওয়ের খবরের কাগজ ছিল-ইনাডু। কাগজটির সম্পাদক তিনিই ছিলেন। রিপোর্টারদের থেকেই ‘লোফার’-এর সেটের বিষয়ে খবর পেয়েছিলেন রাওবাবু। তৎক্ষণাৎ চেনাশোনা এক ইঞ্জিনিয়ারকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সব দেখেশুনে রামোজি রাওকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ারের মুখে সেটের সুখ্যাতি শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন স্বয়ং এসে আমার সেট দেখে যাবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। এই গল্পটা জানলে আপনারা খুব মজা পাবেন। আমি অপেক্ষা করছি রামোজি রাওয়ের জন্য। প্রথমে দেখি একটা সাদা রঙের অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ি ঢুকল। তার থেকে একজন আপাদমস্তক সাদা জামাকাপড় পরা মানুষ নামলেন। তিনি এসে বললেন, চেয়ারম্যান স্যার আসছেন। তারপর দেখি ৪০টা সাদা গাড়ি এল। এক্কেবারে শেষের গাড়িটা থেকে নামলেন রামোজি রাও। সবাই যেরকম সাদা জামা-প্যান্ট পরে মানুষটাকে দেখেছেন, ঠিক সেইরকম সাদা জামা-প্যান্ট পরে নামলেন তিনি। এসেই আমাকে বললেন, “মডেলটা দেখি।” আমার সেটের একটা মডেল তৈরি করা ছিল। সেটা মন দিয়ে দেখলেন। বললেন, “চলো আমি হাঁটব তোমার সঙ্গে।” তারপর তিনি হেঁটে-হেঁটে দেখতে লাগলেন সেট। সেদিন কিছুই আর বললেন না আমাকে।

রামোজি রাওয়ের সঙ্গে নীতীশ রায়… (নীতীশের অ্যালবাম থেকে)

তারপর এল ডাক! বললেন, “আমি কোনওদিনও দ্বিতীয় হইনি”

রামোজি রাওয়ের রাইট-হ্যান্ডের নাম বাপি নিডু। তিনি আমাকে ফোন করলেন পরদিন। সকাল ০৯.৩০টা-১০.০০টা নাগাদ রাওয়ের অফিসে ডাকলেন আমাকে। আমি যে হোটেলে থাকতাম, সেই হোটেলের নীচেই দেখলাম দাঁড়িয়ে আছেন বাপি। আমাকে নিতে এসেছেন গাড়ি করে। আমাকে ধরে নিয়ে চলে গেলেন রাওয়ের অফিসে। আমাকে ওয়েলকাম করে বসতে বললেন। হাজির হলেন রামোজি রাও। জানলাম, রাও তখন মনে-মনে এক সুবিশাল ফিল্ম সিটি তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন। চওড়া হেসে বললেন, “আমার সেট দারুণ লেগেছে। আমি এরকমই একটা সিনেমার জগৎ তৈরি করতে চাই। চিত্রনগরী তৈরি করতে চাই। এটা আমার ড্রিম প্রজেক্ট। তুমি করতে পারবে?” সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আমাকে। নির্ভীক আমি উত্তর দিলাম, “কেন পারব না, নিশ্চয়ই পারব।” আমাদের কথাবার্তা চলতেই থাকল। অকপট বললেন রামোজি রাও, “আমি কিন্তু জীবনে কোনওদিনও সেকেন্ড হইনি কোনও কাজে। আমি চিরকালই ফার্স্ট হয়েছি।” আমি অকপট বলেছিলাম সেদিন, “ফার্স্ট হওয়ার কথা কিন্তু আমি আপনাকে দিতেই পারব না।” তারপর তো আমরা সত্যিই নম্বর ওয়ান হলাম। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে আমাদের নামও উঠল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম সিটি নির্মাণের স্বীকৃতি এল।

(নীতীশের অ্যালবাম থেকে)

রামোজি ফিল্ম সিটি তৈরি করার সময় আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিরাট-বিরাট পাহাড় পর্বতে ঘেরা ছিল জায়গাটা। আমাদের আগে একটা লোক যেত লাঠি দিয়ে গাছ সরাতে-সরাতে। রামোজিবাবু, আমি এবং দু-একজন ইঞ্জিনিয়ার পিছন-পিছন গাছ সরাতে-সরাতে যেতাম। রামোজি বাবু ওই বয়সেও আমার সঙ্গে হেঁটে-হেঁটে ঘুরতেন সবটা। কোনও ক্লান্তি ছিল না লোকটার। শিশুর মতো উচ্ছ্বাস দেখতে পেতাম তাঁর দু’চোখে। এক বছর ধরে ঘুরে-ঘুরে টোপোগ্রাফি ঠিক করি আমরা। ঠিক হল কোথায় কী তৈরি হবে। কোন পাহাড় কাটা হবে, কোথা থেকে রাস্তা হবে, সব স্থির হল। সেটা ছিল আমাদের মাস্টার-প্ল্যান। এখন যে মেইন রাস্তা দিয়ে রামোজি ফিল্ম সিটিতে ঢোকা যায়, সেই ব্যবস্থাও রামোজি রাও-ই করেছিলেন। গ্রামের মধ্যে দিয়ে ঘুরে-ঘুরে আসা তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি হাইওয়ে দিয়ে রামোজির এন্ট্রি চেয়েছিলেন। সেটাই করা হল। একদিন সকালবেলা আমরা তিন-চারজন হাঁটতে শুরু করি। পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে মেইন রাস্তায় পৌঁছালাম বিকেল ৩টে-৪টে নাগাদ। আমি আর্তনাদ করেছিলাম, “এ তো অনেক খরচ।” রাও অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “টাকা নিয়ে ভাববে না। জমি আমি সব কিনে নেব। লেভেলিং করতে হবে আগে। না হলে ফিল্ম সিটিতে ঢোকার রাস্তাই তৈরি হবে না।” রাস্তা তৈরি করার এক্সপার্টকে ডাকা হল। জমিটমি কেনা হল। রাস্তা তৈরি হল। ১০০০ কোটি টাকায় তৈরি হয়েছিল রামোজি ফিল্ম সিটি। ২০০০ কারিগর কাজ করেছেন। ১০জন ইঞ্জিনিয়ার কাজ করতেন। অনেক কারিগর খাড়াই পাহাড়ে উঠে কাজ করতে গিয়ে নীচে পড়ে আহত হয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে আমি কাজে হাত দিই। ২০০০ সালে রামোজি ফিল্ম সিটি তৈরি হয়। ১৯৯৮ সালে খোলে ফিল্ম সিটির দরজা। দীর্ঘ ৭ বছর সময় লেগেছিল।

বাঙালির বুদ্ধিতেই আস্থা ছিল রামোজি রাওয়ের

বাঙালিদের বুদ্ধিমত্তায় ভীষণ আস্থা ছিল রামোজি রাওয়ের। বলতেন, এই জাতিটার খুব মেধা, খুব বুদ্ধি। বাংলার সংস্কৃতির প্রতি তাঁর একটা টান ছিল। আমি জীবনে অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি, কিন্তু এরকম ভাল মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি, যাঁর এত উৎসাহ কাজে। উনি তো ফিল্ম সিটি তৈরির টাকা দিয়েই খালাস হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু না। নিজে থেকে তদারকি করেছেন। রামোজি ফিল্ম সিটিটা ছিল ওঁর প্রাণভ্রমর। হায়দরাবাদের বেগমপেটের বিরাট বাড়িটা ছেড়ে তিনি পাকাপাকিভাবে থাকার ব্যবস্থা করে নিলেন ফিল্ম সিটির ভিতরেই। আমি রামোজি ফিল্ম সিটির কাজ করেছিলাম সেখানে থেকেই। ৭ বছর ছিলাম সেখানে। কেবল রামোজি ফিল্ম সিটি তৈরিতেই মন দিয়েছিলাম। তারপর আরও ১০ বছর অন্যত্র কাজ করেছি। রামোজি ফিল্ম সিটি সফলভাবে তৈরি করতে পেরেছিলাম বলে অনেক কাজের সুযোগ এসেছিল। এনটিআর গার্ডেন, এনটিআর সমাধি, আর্ট গ্যালারি, ডান্স গ্যালারি সব তো আমারই তৈরি করা।

রামোজি ফিল্ম সিটি ঘুরছেন রামোজি রাও (নীতীশের অ্যালবাম থেকে)

রামোজি ফিল্ম সিটি আমি তৈরি করলেও, সেই নান্দনিক কাজে সব সময় পাশে পেতাম রামোজি রাওকে। সব কিছু তো আমার মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল না। কিছুটা তাঁরও মাথা থেকে বের হত। নিউজ় পেপারের লোক ছিলেন বলে প্রচুর বিদেশি ম্যাগাজ়িন পড়তেন রামোজি রাও। ভাল বাড়ি, কাপ-প্লেটের ছবি, ফুলদানির ছবি–যা দেখতে পেতেন, বই থেকে পাতা ছিঁড়ে ক্লিপ করে আমাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমি সেগুলো দেখেও আইডিয়া করে নিতাম। নিজের ক্রিয়েটিভ আডিয়া আমাকে জানাতেন। এভাবেই ৭টা বছর আমাদের কাটল। রামোজি ফিল্ম সিটির দরজা খোলার পর চারদিকে হইচই পড়ে গেল। কত লেখালিখি, কত আলোচনা। আমি লাইমলাইটে চলে এলাম। সবাই বললেন, অন্ধ্রপ্রদেশে (এখন তেলেঙ্গানা) এক বাঙালি তৈরি করেছে বিরাট ফিল্ম সিটি। তারপর একদিন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে রামোজি ফিল্ম সিটির নাম উঠল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম সিটি হিসেবে। খবরটা প্রথম জানতে পেরে শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠেছিলেন রামোজি রাও। আজও সেই হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ক্ষণে-ক্ষণে। আরও একটা কথা বলি শুনুন তবে। ‘বাহুবলী’, ‘আরআরআর’, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এর মতো একাধিক ভিএফএক্স সমৃদ্ধ ছবি এখন তৈরি হয়েছে। কিন্তু বহু বছর আগে, সেই ১৯৯২-৯৩ সালে ভিএফএক্স স্টুডিয়ো রামোজি রাও তৈরি করে ফেলেন তাঁর ফিল্ম সিটিতে। সেই সেকশনের নাম ছিল ‘মান্ত্রা’। সেখানেই তৈরি হয় কমল হাসানের একটি ভিএফএক্স নির্ভর দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। তখনকার দিনে সেই ছবি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেল কেবল ভিএফএক্সের জন্যই।

রামোজি ফিল্ম সিটির উদ্বোধনের দিন (নীতীশের অ্যালবাম থেকে)

রামোজি ফিল্ম সিটিতে কি সত্যিই ভূত আছে?

অনেকেই বলেন, রামোজি ফিল্ম সিটিতে নাকি ভূত আছে। জায়গাটাকে হন্টেড বলা হয়। তবে জায়গাটা কিন্তু কবরিস্তানের উপর তৈরি হয়নি। আদিবাসীরা থাকতেন। সাড়ে তিন হাজার একর জমির মধ্যে তাঁদের কারও মৃত্যু হলে হয়তো কবরটবর দিয়েও থাকতে পারেন। কিন্তু তাই বলে রামোজি ফিল্ম সিটিকে ভুতুড়ে জায়গা বলা যায় না। আমি নিজে সেখানে রাতে একা থেকেছি। তখন তো আরও শুনশান ছিল। কই আমাকে তো ভূত দেখা দিল না কোনওদিনও। কিছু বুনো শুয়োর ছিল। বিরাট-বিরাট পাইথন ছিল। বন্য পশু ছিল। কিন্তু ভূত ছিল না। ছিল আর আছে কেবল ভবিষ্যৎ…

রামোজি ফিল্ম সিটি…