সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে বিদ্যাবুদ্ধি চলে যাবে—সেই ভয়ে অনেকে কুল খায় না। সরস্বতীকে তুষ্ট করতে কত কী-ই না করে মানুষ। একটাই ভয়, ভুলচুক হলে সরস্বতী সব বুদ্ধি নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু কেউ কি এমন আছেন, যাঁর সঙ্গে বীণাদেবীর টক-ঝাল-মিষ্টি সম্পর্ক? পান থেকে চুন খসলে, সুরে সুর না লাগলে, সরস্বতীর গালে চড়ও মারতে পারেন তিনি। সেই গায়িকা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। এককথায় তাঁকে ‘সরস্বতীর বরকন্যা’ বলা হয়। সরস্বতী আশীর্বাদের হাত রেখেছেন তাঁর মাথায়। প্রতিবছর বাড়িতে বড় করে বাগদেবীর আরাধনা করেন হৈমন্তী। এবার আবার সরস্বতী পুজোর দিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বাঙালির প্রেম দিবসের সঙ্গে ইউরোপীয় ভালবাসা মিলেমিশে একাকার হবে। তার আগেই প্রেম, বিয়ে, সংসার, গান এবং সরস্বতীকে নিয়ে TV9 বাংলার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিলেন হৈমন্তী। হৈমন্তী যা বললেন, তুলে ধরল TV9 বাংলা।
সরস্বতীর সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক:
আমি সেভাবে বিয়ে-থা করে সংসারি হইনি। কিন্তু মা সরস্বতীকে নিয়েই আমার সংসার। আমার ঘরে ঢুকলে একটা পুজো-পুজো ভাব হয়। তবে পুজো ভাব আছে বলে নিয়মকানুন মানতে হবে, সেটা কিন্তু আমি মনে করি না। মা কিংবা বন্ধু বলেই ভাবি সরস্বতীকে। ভাল কিছু করলে ওর দিকে তাকাই। আর খারাপ কিছু ঘটলে ওঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি, এমন কেন হল আমার সঙ্গে? তবে সরস্বতী আমাকে কতখানি ভালবাসেন, তা জানি না। এটুকুই বলতে পারি, অনেক আশীর্বাদ পেয়েছি ওর কাছ থেকে। না হলে এতগুলো বছর ধরে গান গেয়ে যাচ্ছি কীভাবে, বলুন? মাঝেমাঝে সরস্বতীকে আমি গালাগালিও করি।
অষ্টধাতুর সরস্বতীর আগমনে চমৎকার ঘটে যায়:
সরস্বতীর আমার বাড়িতে আসাটাও একটা বিরাট গল্প। ছোটবেলা থেকেই পুজো হয়। বাড়িতে ঠাকুর আসে। সারাবছর থেকে পুজোর আগেই ভাসান হত মাটির বিগ্রহের। এমনই ছিল রীতি। একবার সরস্বতী পুজোর আগে আমি পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে-হাঁটতে একটা অ্যান্টিকের (পুরনো দিনের জিনিস বিক্রির দোকান) দোকান পেরিয়ে যাচ্ছি… হঠাৎ দেখি এই ভদ্রমহিলা (সরস্বতীর বিগ্রহ) ধুলোটুলো মেখে বসে আছেন এক কোণায়। আমার এক ছাত্র বলল, ‘পিসি দেখবে এসো, এখানে কে বসে আছেন!’ দেখেই মনে হল, ইনি আমার বাড়ি যাবেন…
দোকানদার হৈমন্তীকে দেখে বলেন সরস্বতীর মূল্য় তিনি দিতে পারবেন না:
দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত দাম ওই সরস্বতীর মূর্তির। আমাকে দেখে তাঁর (দোকানমালিক) পছন্দই হয়নি। বলেই দিলেন, ‘সরস্বতীর দাম আমি দিতে পারব না।’ কিছুতেই দামটা আমাকে বলতে চাইছিলেন না তিনি। মন খারাপ করে দোকান থেকে চলে আসছি, এমন সময় পিছন থেকে ডাকেন সেই দোকানদার। জিজ্ঞেস করলেন, “দিদি আপনি গান করেন না? নিয়ে যান ওকে (সরস্বতীর মূর্তি)।” আমার ব্যাগে তখন দশ হাজার টাকা ছিল। সেই টাকার বিনিময়ে আমি এই মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে আসি। সেই থেকে ওর সঙ্গে আমার সংসার পাতা শুরু।
গাইতে না পারলে সরস্বতীকে মারেন চড়:
সরস্বতীকে আমি আমার বাড়ির মেয়ের মতোই মনে করি। মনে করি ও আমার পরম আত্মীয়। আমার বাবা বলতেন, চার হাতের সরস্বতীকে পুজো করা উচিত। আমি সেই মতোই নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। ওর চারটেই হাত। যা আমার পছন্দ, সেই রকমই শাড়ি ওকে আমি পড়াই। সেইভাবেই ওকে সাজাই। বাবার সুরমন্দির সঙ্গীতভবন ছিল। সেখানে পুজো হত। বাবা-মা চলে যাওয়ার পর সেই পুজোটা আমার বাড়িতে হয়। ভাই-বোন-ছাত্র-ছাত্রীরা আসেন।
কেন সংসার হল না হৈমন্তীর?
গানকে বিয়ে করে নিয়েছিলাম সেই ছোট বয়সে। জানতাম, সংসার করতে শুরু করলে আমার গান হবে না আর। সেটার সঙ্গে আপোশ করিনি। গানই আমার প্রেমিক। সেই আমার ভ্যালেন্টাইন। গানের সঙ্গেই আমার আজীবনের প্রেম। আর সরস্বতী হল প্রেমের উপরে কেউ যদি থাকে, সে। আমি যখন গানের মধ্যে ডুবে যাই, রক্ত-মাংসের মানুষের অভাববোধই করি না।