শেক্সপিয়র বলেছিলেন, ‘হোয়াটস ইন আ নেম’। তিনি ইংরেজ। তাই নামে তাঁর যায় আসেনি কিছুই। কিন্তু বঙ্গদেশে জন্মালে, শেক্সপিয়রকেও লিখতে হত, ‘হোয়াটস ইন আ সারনেম’… আর সেই কাহিনিতে নায়ক হতেন বাঙালি অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়। একটা সময় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, শূদ্র নিয়ে সমাজের গোঁড়ামি তছনছ করেছে বহু ছেলেমেয়ের জীবন। জাত-পাত বড় বালাই। এই গোঁড়ামির শিকার হয়েছিলেন খরাজ। এটা তাঁর নিজের জীবনের গল্প, যে গল্প তিনি শেয়ার করেছেন TV9 বাংলার সঙ্গে। ৩০ বছর পূর্ণ করে এবার ৩১ বছরে পা দেবে খরাজ মুখোপাধ্যায়ের দাম্পত্য জীবন। তার আগেই দাম্পত্য জীবনের গল্পের ঝাঁপি খুললেন ইন্ডাস্ট্রিতে এই মুহূর্তে ‘বগলামামা’ বলে চর্চিত খরাজ মুখোপাধ্যায়।
তৎকালীন প্রেমিকা প্রতিভা রায় স্বর্ণকারকে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯৩ সালে। বীরভূমের গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে খরাজ। পরিবারের পুরুষেরা পৌরহিত্য করেন। যে পাত্রীকে পছন্দ করেছিলেন খরাজ, তিনি অব্রাহ্মণ (আগেই বলা হয়েছে প্রতিভাদেবীর পদবি ‘রায় স্বর্ণকার’)। গ্রামের ব্রহ্মাণ পরিবার কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না এই বিয়েকে। সবার আগে প্রতিবাদ করেন খরাজের বাবা। খরাজকে সটান বলেছিলেন, “আর কোনও মেয়ে পেলে না বিয়ের করার জন্য…?” ছেলের সঙ্গে কথা বন্ধ করেছিলেন সেই গোঁড়া বাবা।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। মৃত্যুশয্য়ায় তাঁর কট্টরপন্থী বাবাকে শেষবার জল খাইয়েছিলেন খরাজের অব্রাহ্মণ স্ত্রীই। কিন্তু যে পুত্রবধূকে একসময় ‘দূর-দূর’ করেছিলেন খরাজের পিতা, তাঁর এত কাছে কীভাবে গেলেন প্রতিভা, বাস্তব কাহিনি হার মানাবে সিনেমার চিত্রনাট্য়কেও।
অব্রাহ্মণ মেয়েকে বিয়ে করার জন্য গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারগুলি চটল খরাজের পরিবারের উপর। রুষ্ট হলেন তাঁর বাবা। খরাজ TV9 বাংলাকে বলেছেন, “বাবার অমতে বিয়ে করেছিলাম। সেই বিয়েতে বাবা আসেননি। আমি ভেবেছিলাম বাবা আর কোনওদিনও আমার মুখ দেখবেন না। কিন্তু আমার বড়দা যা করলেন…”
আসলে সস্ত্রীক খরাজকে ফের আপন করে ঘরে তোলার পিছনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁর বড়দা। পৌরহিত্যে পটু এই মানুষটি প্রথমে মহাদেবের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন খরাজের হবু স্ত্রী প্রতিভার। কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগে ভেসে যাচ্ছিলেন খরাজ। স্মৃতিরোমন্থন করতে-করতে বলছিলেন, “হিন্দু ধর্মে এমন রীতি আছে, যেখানে মহাদেবের সঙ্গে বিয়ে হলে সেই মেয়ে গোত্রহীন হয়ে যায়। তাঁকে তখন যে কেউ বিয়ে করতে পারেন। আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছিল।”
শেষমেশ বিয়ে করলেন খরাজ। বিয়ের পর তাঁর কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে ঠাঁই পাননি অভিনেতা। মামারবাড়ি ছিল পাশে। বেহালার একটি ভাড়াবাড়িতে উঠেছিলেন। পেতেছিলেন নতুন সংসার। বিয়ের পর স্ত্রী বায়না ধরেন, তাঁকে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে নিয়ে যেতেই হবে। এই আবদার শুনে খরাজ বলেছিলেন, “ক্ষেপেছ নাকি বাবু? তোমাকে বাবা দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেবেন। তোমার এই অসম্মান আমি সহ্য করতে পারব না।” অকুতোভয় স্ত্রী সে দিন বলেছিলেন, “দিলে দেবেন। কিন্তু বাবার আশীর্বাদ ছাড়া আমি নতুন জীবন শুরু করতে পারব না।”
স্ত্রীর বায়না মেটাতে তাঁকে নিয়ে বাবার কাছে গেলেন খরাজ। তারপর যা হল, কোনওদিনও তা ভুলবেন না অভিনেতা। বাবার ঘরে স্ত্রীর প্রবেশ ঘটার মিনিট ১৫ পর খরাজ সেই ঘরে ঢুকে দেখেন, শ্বশুরমশাইয়ের পা টিপে দিচ্ছেন প্রতিভা। তা দেখে হকচকিয়ে গেলেন খরাজ… বললেন, “ও বাবা! সে কী কাণ্ড। এতকিছুর পর এই দৃশ্য দেখব ভাবিনি। তারপর দিন সাতেক যেতেই বড়দা এসে আমাকে আর প্রতিভাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মজার কথা কী জানেন, আমার অব্রাহ্মণ স্ত্রীর হাতেই শেষ জলটুকু খেয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন বাবা।”
অনুলিখন: স্নেহা সেনগুপ্ত