স্নেহা সেনগুপ্ত
একটা কাঁচা হলুদ রঙের সরষে ক্ষেত। সেই সরষে ক্ষেতে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, গালে টোল-পড়া ‘সাধারণ হয়েও অসাধারণ’ দেখতে রাজ মালহোত্রা। তাঁর দিকে সিমরনের স্লো মোশনে দৌড়ে আসা… ম্যান্ডোলিনে ঝড় তোলা এক সুর… এ দৌড় যেন কেবল সিমরনের নয়। তার মতো বহু… অগুণতি… অসংখ্য… নারীর, থুড়ি প্রেমিকার। আদর্শ প্রেমিকের অপেক্ষায় থাকেন যাঁরা… ছোট থেকে এই দৃশ্যকে মনে-মনে কল্পনা করে ‘আদর্শ প্রেমিক’-এর ইমেজ তৈরি করেছে এ দেশের লক্ষ-কোটি তরুণী। ৯০-এর দশকের ‘নায়ক’ শাহরুখ খান সেই রোম্যান্টিসিজ়মের ‘পোস্টার বয়’। সাধারণ চেহারার ‘পাঠান’ ছেলেটির উইএসপি ছিল না অভিনয়। কোনও এক ‘এক্স ফ্যাক্টর’কে বগলদাবা করে ময়দানে নেমেছিল সে। পরিবর্তে পেয়েছিল বিপুল সাফল্য। সিরিয়াল থেকে শুরু করেছিল সেই ছেলে; তার আগে থিয়েটার। ধীরে-ধীরে সিনেমায় পদাপর্ণ করেন ছক-ভাঙা চরিত্রে। ‘ডর’ ছবিতে সাইকোপ্যাথ প্রেমিক রাহুল মেহরা। ‘বাজ়িগর’-এও প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলতে থাকা অজয় শর্মা। ‘অ্যান্টি হিরো’র চরিত্র দিয়েই বলিউডের নজর কেড়েছিলেন কিং। তারপর জীবনে এল ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘কল হো না হো’, ‘মহব্বতেঁ’, ‘বীর-জ়ারা’র মতো ছবি… কেরিয়ারে অন্য ধরনের ছবিও এসেছে। একটা ‘স্বদেশ’ হয়েছে, ‘চক দে ইন্ডিয়া’, ‘মাই নেম ইজ় খান’ হয়েছে। হয়েছে ‘ফ্যান’, ‘জ়িরো’র মতো ফ্লপও। কিন্তু কোনওদিনও ভাঙতে পারেনি তাঁর রোম্যান্টিক হিরোর ইমেজ। এবার ঠিক সেই ইমেজটাই ভাঙার চেষ্টা করলেন শাহরুখ। যে ধারার ছবিতে তিনি কোনওদিনও নাম লেখাননি, অথচ চেয়েছেন গত ২৫ বছর ধরে (নেটফ্লিক্সের ডকুমেন্টারি সিরিজ় ‘দ্য রোম্যান্টিক্স’-এ স্পষ্ট বলেছেন শাহরুখ যে, আদিত্য চোপড়াকে দু’-দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বলেছেন তাঁকে যেন একটা পুরোদস্তুর ‘অ্যাকশন হিরো’র চরিত্র দেওয়া হয়), সেই অ্যাকশনধর্মী ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’ করলেন ৬০ ছুঁই-ছুঁই ‘বাদশাহ’ (আজ শাহরুখের ৬৮তম জন্মদিন)। এবং আবারও প্রমাণ করলেন সেই শতাব্দী প্রাচীন আপ্তবাক্য ‘এজ ইজ় জাস্ট আ নাম্বার’।
বাদশাহর বয়স হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে। আর ঠিক তাই-ই তিনি ‘জওয়ান’। হাড় জোর কমছে, ঠিক সেই কারণেই তিনি ‘পাঠান’। ‘ওল্ড ওয়াইন ইন আ নিউ বটল’, বললেন বাংলা সিনেমার এক সময়কার ‘অ্যাকশন হিরো’ চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। মজার বিষয় হল, ২ নভেম্বর চিরঞ্জিতেরও জন্মদিন। দুই সুপারস্টারের ফারাক কেবল বয়সে। শাহরুখের চেয়ে ১০ বছরের বড় তিনি। রোম্যান্টিসিজ়মের পোস্টার বয়ের ইমেজ ছিঁড়ে অ্যাকশন হিরোর তকমা অর্জন করার চেষ্টা একজন অভিনেতার কাছে কতখানি চ্যালেঞ্জের, জানতে চেয়েছিল TV9 বাংলা।
বাংলার বুকে বাণিজ্যিক ছবির প্রয়োজনীয়তা, সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, তা নিয়ে বরাবরই অকপটে কথা বলে এসেছেন চিরঞ্জিত। দর্শকের ভাললাগে মারামারি। সেই ছবির সংখ্যা কমে যাচ্ছে দেখে তিনি উষ্মাও প্রকাশ করেছেন, “এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আমাদের এখানে মাথায় কৃত্রিম টাক তৈরি করে ‘আয় খুকু আয়’ করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আমার মনে হয় অভিনেতাদের জীবনে একটা সাকসেস কার্ভ থাকে। বিজ্ঞানীদের জীবনেও সেটা থাকে। শাহরুখ ছবির ব্যাপারে খুবই ইন্টারেস্টেড। তাঁর ইমেজ সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন।” তাহলে কি ৬০-এর কাছাকাছি এসে এই ইমেজ ভাঙার চেষ্টা করা আসলে ‘সাকসেস কার্ভ’-এর পিঠে চাপড় মেরে বলা, ‘আ রাহা হুঁ ম্যাঁয়’ (‘পাঠান’) অথবা ‘রেডি-ই-ই-ই…’ (‘জওয়ান’)? চিরঞ্জিত বলেন, “সেই সাকসেস কার্ভটা পড়েছে শাহরুখের। আমি এটাও মনে করি শাহরুখের ইমেজ পাল্টানোরও দরকার আছে। ওর তো বয়স হয়েছে। তাই সেই বয়সে রোম্যান্টিক হিরো হওয়া যাবে না। চেহারা সেটা সাপোর্ট করছে না। কাজেই সেটা একটা ব্যাপার। শাহরুখ একটি গ্রিন প্যাশচারে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সেই জন্যই তিনি ‘জওয়ান’ তৈরি করছেন। কারণ ‘জওয়ান’ শব্দের মধ্যেই তারুণ্য লুকিয়ে আছে। নতুন বোতলে পুরনো ওয়াইন রাখা হচ্ছে। এবং সেটাই উচিত।” এবং এরপরই আবারও সোচ্চার দীপক ওরফে চিরঞ্জিত। নিজের দীর্ঘদিনের ‘স্ট্যান্ড’-এ আবারও অনড় অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রশিল্পী, গল্পকার চিরঞ্জিত, “আর আমি সেটাই বলছি বহু বছর ধরে। বাংলা ছবির কোনও পরিবর্তন আসেনি। সেটা শাহরুখ, কমল হাসান, সানি দেওলের মতো অভিনেতারা ক্রমাগতই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের পুরনো ইমেজ বক্স অফিসে সে রকম পারফর্ম করছে না। তাই নিজেকে আমূল পাল্টে ফেলছেন এই অভিনেতারা। আমি চাই বাংলাতেও এই পরিবর্তন আসুক। কিন্তু হচ্ছে না। ফলে সেই হিটগুলো পাই না।”
একদিকে নিজের ইমেজ ছেড়ে ৫৮ বছরের শাহরুখ তৈরি করছেন অ্যাকশন ছবি। অথচ তাঁরই সঙ্গে জন্মদিন ভাগ করে-নেওয়া ৭০ ছুঁই-ছুঁই চিরঞ্জিত কেন ফের রজনীকান্তদের মতো অভিনয় করছেন না অ্যাকশন ছবিতে? উত্তরে বললেন, “শাহরুখের কিন্তু মাঝে ৯টা ফ্লপও আছে। ভুললে চলবে না। তার উপর বিপুল টাকা আছে রেড চিলিজ় (শাহরুখের প্রযোজনা সংস্থার)-এর। ও ঝুঁকি নিতে পারে… ও শাহরুখ…” ঠিকই, ‘ও শাহরুখ’ বলেই তো ২০২৩-এ এসেও অবলীলায় ‘জওয়ান’ আওড়াতে পারেন তাঁর ১৯৯৭ সালের ছবি ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-এর সেই সিগনেচার সংলাপ, “নাম তো সুনা হি হোগা…” আসলে শাহরুখ খান হয়তো এমনই। চির-তরুণ রাজ, রাহুলের ইমেজকে ৫৮-য় এসেও ‘জওয়ান’-এর সংলাপের মাধ্যমে তিনি ছড়িয়ে দিতে পারেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী… ‘জওয়ান’ থিম সং-এর লিরিক্সটা মনে নেই? “ইউ নো উই গেম টাইম, অন দ্য ফ্রন্ট লাইন, টিল ইটস ওভার/ডিপ ইন দ্য ট্রেন্টেচ ফর উই, লাইক আ সোলজার”। আসলে এসআরকে তো সেই ‘মাদক-কাণ্ডে জড়িত অভিযোগে ধৃত’ পুত্রের পিতা… সেই ক্ষতবিক্ষত ‘সোলজার’, থুড়ি ‘জওয়ান’, যিনি সিনেমার প্রি-রিলিজ় পর্বে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা-বলা বন্ধ করে দিয়েছেন ইদানীং (সম্ভবত অভিমানে)… তবু ৫৮-য় এসেও যিনি ক্লান্ত নন এতটুকুও… তিনিই তো সেই প্রকৃত ‘আজ়াদ’ (‘জওয়ান’-এ তাঁর একটি চরিত্রের নাম), যিনি কোটি-কোটি ভারতবাসীর হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারেন মনে-মনে একটা গান গুনগুন করতে-করতে, “ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি…”