বাবা, জামাইবাবু, সবাইকে কেড়ে নিয়েছিলেন মা সরস্বতী: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়

Sneha Sengupta |

Feb 15, 2024 | 10:53 AM

Sabitri Chattopadhyay: প্রতি বছর ঘটা করে তাঁর আলিপুরের বাড়িতেই পালিত হত সরস্বতী, লক্ষ্মী পুজো। আগামীকালও (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪) সে রকমই একটি সরস্বতী পুজোর দিন। ৮৬ বছর বয়সি কিংবদন্তি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় চেয়ার-টেবিলে বসে আরাধনা করবেন বাগদেবীর। ফুল ছোঁয়াবেন সরস্বতীর পায়ে, মন্ত্র পড়বেন, 'ওঁ জয়জয় দেবী চরাচর সারে।' তাঁর সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পারল TV9 বাংলা...

বাবা, জামাইবাবু, সবাইকে কেড়ে নিয়েছিলেন মা সরস্বতী: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
স্মৃতির সরণীতে সাবিত্রী।

Follow Us

বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সেই ফ্রক-পরা সাবিত্রীর অভিনয় জীবন শুরু হয় ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে। প্রথম ছবি। অভিনয় করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ২০০ টাকা। সেই থেকে শুরু। বাবার একার রোজগারে বিরাট সংসার চলত না। দেশভাগের পর কলকাতায় এসে অথৈ জলে পড়েছিল চট্টোপাধ্যায় পরিবার। তাঁকে নিয়ে ১০ জন বোন, বাবা, মা, ঠাকুমা… এতগুলো পেট চালানোর একার দায়িত্ব সেই ছোট বয়সেই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিলেন সাবিত্রী। শিল্পের দেবী সরস্বতী এবং ধনের দেবী লক্ষ্মীকে করেছিলেন সম্বল। প্রতি বছর ঘটা করে তাঁর আলিপুরের বাড়িতেই পালিত হত সরস্বতী, লক্ষ্মী পুজো। আগামীকালও (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪) সে রকমই একটি সরস্বতী পুজোর দিন। ৮৬ বছর বয়সি কিংবদন্তি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় চেয়ার-টেবিলে বসে আরাধনা করবেন বাগদেবীর। ফুল ছোঁয়াবেন সরস্বতীর পায়ে, মন্ত্র পড়বেন, ‘ওঁ জয়জয় দেবী চরাচর সারে।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পারল TV9 বাংলা…

চিরকালই শিল্পের কদর করে এসেছেন আবেগপ্রবণ সাবিত্রী। গ্লিসারিন না দিয়ে কাঁদতে পারতেন লহমায়। ছবিতে তাঁর কান্নার দৃশ্যে অভিনয় কিছুতেই ভুলতে পারেন না দর্শক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুর্দান্ত অভিনেতা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে ডরাতেন। বলতেন, “মঞ্চে কিংবা সিনেমার পর্দায় সাবিত্রীর সঙ্গে পাঠ করলে আমার হাঁটু কাঁপে।” সেই সাবিত্রীর জীবনে প্রেম এসেছে বহুবার। কাকতালীয়ভাবে প্রত্যেকবারই এমন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে তাঁর, যাঁর আগে থেকেই একজন স্ত্রী রয়েছেন। সেজন্য কোনওদিনও বিয়েটাও করা হল না সাবিত্রীর। প্রেমিকের মৃত্যুর সময় তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে দেয়নি পরিবার। কিন্তু সাবিত্রী ভালবেসেছিলেন খুব। এক্কেবারে অন্তর থেকে। সেই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সাবিত্রী দিনযাপন করেন সম্পূর্ণ একা। এহেন সাবিত্রীর কাছে সরস্বতী পুজোয় রয়েছে কেবলই ‘পুজো’। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন নিয়ে কখনও তোলপাড় হয়নি সাবিত্রীর হৃদকোমলে। বলেই ফেলেছেন, “প্রেমের নির্দিষ্ট দিন হয় নাকি, সেটা তো চিরকালীন। লোকের যত বাড়াবাড়ি এই দিনটাকে ঘিরে। আমার কাছে সরস্বতী পুজো মানে কেবলই বাগদেবীর আরাধনা। আমি শুরু থেকেই ঘটা করে নিজের বাড়িতে এই পুজো করে এসেছি। কিন্তু মাঝে বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিছু দুর্ঘটনা ঘটায়।” এর পরই এক হৃদয়-বিদারক উক্তি সাবিত্রীর, “সরস্বতী পুজো আমার থেকে অনেককিছু কেড়ে নিয়েছে।”

বলতে-বলতে সাবিত্রীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। বাবার কথা বলেন সাবিত্রী। তাঁর পিতা শশধর চটোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন এই সরস্বতী পুজোর দিনেই। পিতৃতুল্য জামাইবাবুকেও হারিয়েছিলেন এই সরস্বতী পুজোতেই। সাবিত্রী বললেন, “আমার বাবা, জামাইবাবু, সবাইকে কেড়ে নিয়েছিলেন মা সরস্বতী। তাই তাঁর প্রতি অভিমানে অনেকগুলো বছর পুজো করিনি। গত ৩-৪ বছর ধরে করছি।” কী হয়েছিল সাবিত্রী চট্টোপাধ্য়ায়ের বাবার? অভিনেত্রী জানিয়েছেন, তাঁর মা ইচ্ছাময়ী চট্টোপাধ্য়ায় দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। গরম এক্কেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। শরীর ঠিক করতে দার্জিলিংয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। সেখানেই সাবিত্রীর বাবার বুকে জল জমে। নিউমোনিয়া মতো হয়। বিষয়টিকে গ্রাহ্যই করেননি শশধর চট্টোপাধ্য়ায়। সাবিত্রী বলেন, “চিকিৎসা ব্যবস্থাও উন্নত ছিল না সেই সময়। হেন কোনও ভাল ডাক্তার ছিলেন না, যাঁকে দেখানো হয়নি। বুকের জল বের করতে গিয়েই সরস্বতী পুজোর দিন বাবা মারা যান।” এরপর সাবিত্রীর সংযোজন, “এর কয়েক বছর পর আমার জামাইবাবু (মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়) স্ট্রোক হয়ে মারা যান।” আবেগঘন সাবিত্রী বলেই চলেন, “আমার বাবা সরস্বতী পুজোর দিন তদারকি করতেন সবকিছু। দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন সব ঠিক মতো হচ্ছে কি না। সেই পুজোয় দু’বার উত্তমদাও (মহানায়ক উত্তমকুমার) এসেছিলেন…”

এই বছরও সাবিত্রী সরস্বতী দেবীর পুজো করছেন তাঁর আলিপুরের বাড়িতে। যে বাড়িতে এখন সম্পূর্ণ একা থাকেন কিংবদন্তি। বুকে হাহাকার নিয়ে কথাগুলো বললেন সাবিত্রী, “আমাকে তো একাই সরস্বতী পুজোটা করতে হবে। আমার কেউ নেই। এই গোটা বাড়িটায় ভূতের মতো থাকি। একা-একা সরস্বতী পুজো করব। সরস্বতীর পুজো তো মাটিতে বসে করতে হয়। আমি তো মাটিতে বসতেই পারি না এখন। চেয়ার-টেবিলে বসে সরস্বতীর পুজো করব… তাতে যদি মা তুষ্ট হন। তিনি মনে হয় না আগের মতো আর রুষ্ট হয়ে কাউকে কাড়বে। কাড়লে আমাকেই কাড়বেন। তাতে আমার দুঃখ নেই। মুক্তি আছে। এতকাল তো আমাকে আশীর্বাদই করেছেন তিনি, যে কারণ আজও এই বয়সেও আপনাদের মনোরঞ্জন করে যেতে পারছি।”

উল্লেখ্য, গত একমাস ধরে বাড়ি থেকে বের হননি সাবিত্রী। TV9 বাংলা খোঁজ নিয়ে জেনেছে, বিগত একমাস তাঁর শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। জ্বর, কাশি, সর্দিতে ভুগেছেন অভিনেত্রী। নিয়মিত নেবুলাইজ়ার নিতে হয় ফুসফুসের জন্য। সেই অসুস্থতার মধ্যেই সাবিত্রীর ঘরে আজ মাটির দোয়াত, নারকেল কুল, গাঁদা ফুলের মালা এসেছে। এসেছেন মা সরস্বতী। আশীর্বাদ করতে তাঁর প্রিয় পাত্রীটিকে। যাঁকে কাজল নয়না, সুঅভিনেত্রী বলেই জেনেছে গোটা বাঙালি সমাজ।

Next Article