শিশুর হাসির মতো পবিত্র এবং সন্তোষজনক দৃশ্যের সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা করা যায় ফুল ফোটার। ক্রন্দনরত শিশুকে দেখলে পাষাণেরও মন গলে যায়। তাই কষ্টে থাকা শিশুকে শান্ত করার নানা কৌশল অবলম্বন করতে থাকি আমরা। এমনই একটি উপায়ের নাম ‘খেলনা’। ইতিহাসের পাতা ওলটালে আমরা দেখতে পাই, হাজার হাজার বছর আগেও শিশুর মন ভোলানোর জন্য তখনও বাবা-মায়েরা সন্তানের হাতে তুলে দিতেন মাটির বা পাথরের খেলনা। কিছু জায়গায় ধাতু এবং কাঠের তৈরি খেলনার অস্তিত্বও মিলেছে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও ঘটেছে নানা পরিবর্তন। এখন আর আগের মতো আমরা মাটির বা কাঠের তৈরি খেলনা বাচ্চাকে দিই না। এখন বাচ্চা কাঁদলে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় প্লাস্টিকের রঙবেরঙের খেলনা। একটি বাচ্চার মাছ তিনেক বয়স থেকে শুরু করে মোটামুটি বছর পাঁচেক বয়স পর্যন্ত নানাবিধ প্লাস্টিকের খেলনা তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর অভিভাবকদের এহেন প্রবণতার দিকেই আঙুল তুলছেন বিজ্ঞানীরা! তাঁরা প্রকাশ করেছেন ভয়ঙ্কর শঙ্কা। তাঁদের মতে প্লাস্টিকের এই ধরনের খেলনা থেকে শিশুর দেহে বাসা বাঁধতে পারে ভয়ঙ্কর অসুখবিসুখ! এই আশঙ্কার স্বপক্ষে বিস্তারিত সমীক্ষাও হয়েছে।
সমীক্ষার জন্য গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নির্বাচন করেছিলেন বাচ্চাদের ব্যবহার করা বিরাট সংখ্যক পুরনো খেলনা এবং প্লাস্টিকের নানা সামগ্রী। পূর্ণ বিশ্লেষণের পর হাতে আসে চমকে দেওয়া তথ্য। দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ সামগ্রীতেই রয়েছে টক্সিন বা বিষাক্ত উপাদান। এই ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভূত বাধা তৈরি করতে পারে! এমনকী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে প্রজনন ক্ষমতাতেও!
গবেষণার ফলাফল প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, ‘জার্নাল অব হাজ্যার্ডাস মেটেরিয়াল অ্যাডভ্যান্সেস’-এ। দেখা গিয়েছে, ক্ষতিকর উপাদান থাকায় এই ধরনের প্লাস্টিকের উপাদানগুলি পুনর্চক্রায়ণের পথেও বাধাস্বরূপ! ফলে খেলনা শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন গবেষকরা। সমীক্ষার প্রধান প্রাবন্ধিক অধ্যাপক বিথেইনি কানি আলমরথ –এর মতে খেলনার নমনীয়তা বাড়াতে এবং সামগ্রীগুলিকে অগ্নিনিরোধক করার জন্য তার মধ্যে দেওয়া হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক থ্যালেট, এবং ক্ষুদ্র শৃঙ্খলের ক্লোরিনেডেটে প্যারাফিন।
প্রফেসর বিথেইনি নতুন এবং পুরনো খেলনার মধ্যে তুলনামূলক পর্যবেক্ষণের সময় দেখেন, পুরনো খেলনায় অনেক বেশি পরিমাণে থ্যালেট রয়েছে। এমনকী খেলনার মোট ওজনের প্রায় ৪০ শতাংশই দখল করে রয়েছে থ্যালেট! এই স্টাডির ফলে পুরনো খেলনাগুলিকে পুনর্চক্রায়ণের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে সংশয়। গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল স্লাঞ্জ জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে হলে প্লাস্টিক এবং অন্যান্য সামগ্রীতে ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা স্থাপন করা দরকার।
আসলে আইনের মধ্যেই রয়েছে ফাঁক! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চাদের খেলনা তৈরির সময় খেলনার নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে নজর রাখা হলেও এই নজরদারি বা নিয়মকানুন সবই কিন্তু জারি হয় নতুন খেলনা তৈরির উপর। পুরনো খেলনার ব্যাপারে এই ধরনের নিয়ম কানুন জারি থাকে কি না সেই ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়। এই বিষয়গুলি নজরে আসে ইউরোপিয়ান সংসদ যখন সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করে যাতে পৃথিবীর সীমিত সম্পদ নিষ্কাশন করে ক্ষতিকর বর্জ্যের উৎপাদন বন্ধ করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শিশুদের একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়ার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপাতত, খেলনার নিরাপত্তা নিয়ে ইউরোপে সংশোধিত টয় সেফটি ডাইরেক্টিভ বা সংশোধিত নির্দেশ অনুসারে, নতুন খেলনা তৈরির সময় খেলনার মোট ওজনের ০.১৫ শতাংশ ক্ষুদ্র শৃঙ্খলের ক্লোরিনেটেড প্যারাফিন এবং ০.১ শতাংশ থ্যালেট ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশ্ন হল উন্নয়নশীল দেশগুলি তাদের বাচ্চার ভবিষ্যতের ব্যাপারে কতখানি ভাবছে? খেলনার বিপদ নিয়ে রাষ্ট্রনেতারা আদৌ কি উদ্বিগ্ন?