বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪ জনের মধ্যে ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক ভুগছেন একাকিত্বে। ১৪২টি দেশকে নিয়ে করা ‘গ্যালপ’-এর (একটি বেসরকারি সংস্থা, যা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা ও সমীক্ষা চালায়) নতুন সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই তথ্য। ওই সমীক্ষায় দেখে গিয়েছে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ২৪% মানুষ তাঁদের জীবনে প্রতিনিয়ত একাকিত্ব অনুভব করেন। আর এই একাকিত্বকে কাটিয়ে কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব, সেই প্রশ্নই বর্তমানে হয়ে উঠেছে এক গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা (Public Health Crisis)। এমনকি এই একাকিত্ব ধীরে-ধীরে মহামারির আকার ধারণ করছে (loneliness epidemic)। তাই এই বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO।
গ্যালপের করা এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১৯ থেকে ২৯ বছর বয়সী ২৭% যুবক একাকিত্বে ভোগেন। তবে, তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের মধ্যে একাকিত্ব অনুভব করার হার তুলনামূলকভাবে কম। ৬৫ বছর তার বেশি বয়সী বয়স্কদের মাত্র ১৭% মানুষ নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। অন্যদিকে, ৪৫ বা তার বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কেরা খুব একটা সঙ্গীর অভাব বোধ করেন না। একাকিত্ব অনুভব করলেও সেটা শতাংশের নিরিখে নগণ্য। আবার পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে যদি একাকিত্বের হার বিবেচনা করা হয়, তাহলে এই সমীক্ষায় এগিয়ে রয়েছেন মহিলারা। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১৪২টির মধ্যে ৭৯টি দেশে পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই বেশি একাকিত্বে ভোগেন। যদিও প্রতিটা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট স্বতন্ত্র।
২০২২ থেকে ২০২৩-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪২টি দেশের প্রায় ১০০০ জন করে মানুষের উপর সমীক্ষা চালানো হয়। এই দেশগুলোতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭৭% মানুষ থাকেন। এই সমীক্ষার ফলাফল থেকে কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গিয়েছে যে, বিশ্ব জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ একাকিত্বে ভোগেন। কিন্তু তার চেয়েও উদ্বেগের কারণ এই একাকিত্বের পরিণাম।
একাকিত্বের কারণে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (social isolation) ও একাকিত্ব সমস্ত বয়সের মানুষের উপরই প্রভাব ফেলে। এমনকি একাকিত্ব থেকে তৈরি হওয়া শারীরিক ও মানসিক অবস্থা মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে। ওজন বেড়ে যাওয়া, ধূমপান ও অন্যান্য নেশাদ্রব্যের প্রতি আসক্তি, অনিদ্রা, অস্বাস্থ্যকর খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া একাকিত্ব থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও যে নেহাত কম নেই এই সমাজে। বরং, এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বের কারণে ২৫-৩৩% মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এজওয়েল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হিমাংশু রথ জানিয়েছেন, ২০২১ সালে করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১০,০০০ প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে একাকিত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একাকিত্ব কোনও সাধারণ বিষয় নয়। এটা মহামারিতে পরিণত হতে পারে যে কোনও সময়। তাই একাকিত্বকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবেও বিবেচনা করছে WHO। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে সম্প্রতি প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছে এই ‘একাকিত্ব মহামারি’ (loneliness epidemic) সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং মোকাবিলার স্বার্থে ।
সর্বোপরি, মানুষকে একাকিত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। একা থাকার অর্থ (alone) একাকিত্ব (loneliness) নয়। অনেক সময় বন্ধু, পরিবারের মাঝে থেকেও মানুষ একাকিত্বে ভুগতে পারেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানুষ একা থেকেও ভাল থাকতে পারেন। তবে যাঁরা একাকিত্বে ভুগছেন, তাঁদের এই অবস্থা থেকে বের করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা জরুরি। আর এক্ষেত্রে বন্ধু তৈরি করা, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করা, কোনও নতুন কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার কাজ করা যেতে পারে। এতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হবে এবং নিজের সঙ্গে কীভাবে জীবন কাটাতে হয়, এটাও শেখা যাবে। কবি শঙ্খ ঘোষের কথাই যেন মনে পড়ে যায় ভবিষ্যতের এক নিঃসঙ্গ পৃথিবীর কথা ভাবতে-ভাবতে: “কিছুই কোথাও যদি নেই/তবু তো কজন আছি বাকি/আয় আরো হাতে হাত রেখে/আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”