মা-বাবা দুজনেই অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই বাড়ির ছোট সদস্যকে সময় দিতে পারেন না অধিকাংশ অভিভাবক। ফলে সঙ্গী না পেয়ে খুব ছোট থেকেই স্মার্টফোন, ট্যাবলেটের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায় ছোট শিশুদের মধ্যে। এমনকি ধীরে ধীরে স্ক্রিনটাইমের মাত্রা বেড়ে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যায়। বর্তমান যুগে ডিজিটাল ডিভাইস ছাড়া চলার পথ নেই। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিনটাইমের কারণে চোখ, মস্তিষ্ক, হার্টের উপর প্রভাব পড়ে। ছোট থেকে প্রবীণ, এখন সকলেই মুঠো ফোনের নেশায় বুঁদ। প্রবীণদের থেকে বাচ্চাদের উপর এর প্রভাব যে কী মারাত্মক হতে পারে, সে ব্যাপারে জেনেও সঠিক সময়ে রাশ টানতে ব্যর্থ হোন অভিভাবকরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা স্মার্টফোন, ট্যাবলেটের মতো আকর্ষণীয় ডিভাইসের প্রতি কৌতূহলী হয় সবচেয়ে বেশি। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে এগুলির ব্যবহার অতিপ্রয়োজনীয়। কিন্তু কতক্ষণ দেখবে, কখন স্ক্রিন মিডিয়ায় চোখ রাখবে তার সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার অভিভাবকদের।
২০২২ সালের একটি ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছিল গোটা বিশ্বে। ঘটনাটি হল. একটি ৮ বছরের কিশোরী প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে হরর শো দেখত। টানা ২ বছর ধরে এই শো দেখার পর তার মানসিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাকে পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী থেরাপির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। শিশুর এই ভয়ানক কীর্তি মা-বাবার গোচরে ছিল না। মা-বাবার অনুপস্থিতিতে বা চোখের আড়ালেই চলে এইসব ভয়নাক কাণ্ড। তবে এমন ঘটনার সংখ্যা খুব একটা কম নয়। শিশুবিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম বা স্মার্ট ডিভাইসের উপর চোখ রাখলে শিশুদের আচরণে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শুধু কিশোর-কিশোরীরা নয়, দুই বছর থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যেও আচরণে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। স্ক্রিন মিডিয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে গেলে শিশুদের মধ্যে কিছু বিশেষ আচরণগত পরিবর্তন চোখে পড়ে। স্কুলের যে কোনও পরীক্ষায় ক্রমাগত কম নম্বর পাওয়া, স্কুলের হোমওয়ার্কে বারবার সাধারণ ভুল করা, ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে অমনোযোগী পড়ুয়া হিসেবে গণ্য হওয়া, অনিদ্রা, রাতে ঘুমের মাঝে কেঁদে ওঠা, ইন্টারনেট গেমে ক্রমাগত হেরে যাওয়া, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, উদ্ধত আচরণ করা, সবসময় খিটখিটে মেজাজ থাকলে অবিলম্বে শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এই লক্ষণগুলি শিশুর মধ্যে দেখা দিলে স্মার্টফোন দেখার প্রতি প্রশ্রয় না দেওয়াই উচিত।
শুধু তাই নয়, মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ দেখার ফলে বাচ্চারা চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায় না, নিজেকে সকলের থেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে, ঘরকুনোর হয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়, নিজের খেলনা নিয়েই মত্ত থাকার প্রবণতা তৈরি হলে সাবধান হতে হবে অভিভাবকদের। শিশুবিশেষজ্ঞদের কথায়, বর্তমানে এমন অনেক অভিভাবকরা অভিযোগ নিয়ে আসেন যাঁরা সন্তানদের উপর নজর রেখেও সমস্যার হাল ধরতে পারছেন না। আবার অনেকের সন্তানরা মাত্র ৬ ঘণ্টা ঘুমায়, নজর রাখার মতো বাড়িতে কেউ নেই, ইউটিউবে কী ধরনের ভিডিয়ো দেখে তা নিজেরাও জানেন না। সন্তানকে আরামদায়ক পরিবেশ দিতে গিয়ে তাদের হাতে অজান্তেই তুলে দেওয়া হয় ‘বিষ’। অতিরিক্ত স্মার্ট ডিভাইস তো বটেই, ইউটিউবে একনাগাড়ে ভিডিয়ো দেখার কারণে শিশুদের মানসিক অবস্থাও তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সেখান থেকে তাদের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সাইক্রিয়াটিস্টট, প্লে থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্টরা থেরাপি ও ট্রিটমেন্টের পরামর্শ দেন। আর সেগুলির মাধ্যমে শিশুর অবস্থারও উন্নতি হয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাত্র ৬ সপ্তাহ ধরে ট্রিটমেন্ট ও থেরাপি চলার পর শিশুদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। নিজের থেকে পড়তে বসা, পড়ায় মনোযোগ দেওয়া, অন্যের কথায় সাড়া দেওয়া, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করা, প্রতিদিনের কাজকর্ম নিজে থেকেই করার চেষ্টা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগা তৈরি হয়।
তবে শুধু থেরাপি ও ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে আচরণে পরিবর্তন ঘটে, তাই নয়, বাড়িতে সন্তানের উপর নজরও দেওয়া দরকার। স্ক্রিনটাইমের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া, কখন স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করবে, সেদিকে অভিভাবকদের নজর রাখা উচিত। সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহারে রাশ টানা হলে স্কুলে যাওয়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, পড়াশোনায় মনোযোগ বৃদ্ধি, বন্ধু ও প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে ভাললাগা জন্মায়।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অতিমারির জেরে লকডাউনের সময় থেকে অধিকাংশ বাচ্চারা সোশ্যাল মিডিয়া, গেমিংয়ে বুঁদ হয়ে গিয়েছে। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশতে ও খেলতে না পেরে প্রায় সব পড়ুয়ারাই মুখ লুকিয়েছে টিভি, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটের স্ক্রিনে।ফলে সেই ধারা থেকে বের হতেই অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর সঠিক সময়ে রাশ না টানায় শিশুরা ওপিডিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সেই সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বছরে প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ শিশু ওপিডিতে আসার ঘটনা ঘটছে। সাধারণত ১১ থেকে ১৫ বছরের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেশি মাত্রায় স্ক্রিনটাইম দেখার প্রবণতা রয়েছে। তবে ১০ বছরের নীচে যাদের বয়স, তাদের সংখ্যাও ইতোমধ্যে ঊর্দ্ধমুখী। সমীক্ষা দেখা গিয়েছে, মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি আসছে ওপিডিতে। মেয়ে বা ছেলে, সকলের মধ্যেই একই লক্ষণ দেখা যায়। তবে আশার আলো, সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট ও থেরাপি করা হলে ৬০ শতাংশেরও বেশি শিশুই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে।