ঠোঁটের ভাঁজে সুখটানেই মারণ হুমকি! ক্যানসার ছাড়ুন, আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য
ধূমপানের (Smoking) জন্য ৩৬ ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্যান্সার নয়, এই সংক্রান্ত মৃত্যুর কারণ হিসেবে সবার উপরে ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ।
কমলেশ চৌধুরী: দেড় বছরে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ৩৫ লক্ষের। ভারতে সংখ্যাটা ৩ লক্ষ ১৮ হাজার। কিন্তু ধূমপানের জন্য কত মৃত্যু হয়েছে জানেন? চমকে উঠবেন আপনি। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই বিশ্বে ৭৬.৯ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ তামাকসেবন। ভারতে সংখ্যাটা ১০ লক্ষ। এর মধ্যে ৮.৪৫ লক্ষ পুরুষ, ১.৬৯ লক্ষ মহিলা। অর্থাত্, এক বছরের গড় হিসেব ধরলে, ভারতে কোভিডের চেয়ে ৫ গুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে ধূমপানের জন্য।
ভয়াবহ এই পরিসংখ্যানই উঠে এসেছে প্রথম সারির মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের গ্লোবাল ডিজিজ বার্ডেন স্টাডি থেকে। এমনও বলা হয়েছে, ধূমপানের কারণে প্রতিবন্ধকতা-সহ বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে কোনও রকমে জীবন কাটাচ্ছেন আরও অন্তত ২০ কোটি মানুষ। প্রতি ৫ জন পুরুষের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ ধূমপান। মহিলাদের ক্ষেত্রে অনুপাত ২০:১।
ল্যানসেটের সাফ কথা, এখনও ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কড়া না হলে, এই ধরনের মৃত্যু আগামী দশকে আরও বেড়ে যাবে। চিকিত্সাবিজ্ঞানের পত্রিকাটির পর্যবেক্ষণ, কিছু দেশে ধূমপানের হার কমেছে, কিন্তু তামাক নিয়ন্ত্রণে বড়সড় ফাঁক থাকায় সেই সাফল্য চোখে পড়ার মতো নয় একেবারেই। বিশেষ করে ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে জনবিস্ফোরণের জন্য ছোট ছোট ইতিবাচক দিকগুলি বিশেষ পার্থক্য তৈরি করতে পারছে না। প্রয়োজন আরও বেশি কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণের।
ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। শব্দগুলি বহু বছর ধরেই সিগারেট-বিড়ির প্যাকেটে লেখা থাকে। সিগারেটস অ্যান্ড আদার টোবাকো প্রোডাক্টস অ্যাক্ট বা কোটপা (COTPA) ২০০৩ আইন চালু হওয়ার পর থেকে সচেতনতা বাড়াতে সিগারেটের প্যাকেটে ছবিও লাগানো হচ্ছে। কিন্তু ভয় ধরানো সেই ছবিও বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি।
ল্যানসেট বলছে, গত ৩০ বছরে ২০ কোটি মৃত্যুর সঙ্গে যোগ রয়েছে ধূমপানের। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা ১১৪ কোটি। ৩৬৫ দিনে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ কোটি সিগারেট বা বিড়ি সেবন করেছেন তাঁরা। ফলে মৃত্যু এবং আর্থিক ক্ষতি দুই-ই যে লাফিয়ে বাড়বে সে আশঙ্কা করাই যায়।
ধূমপানের জন্য ৩৬ ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্যান্সার নয়, এই সংক্রান্ত মৃত্যুর কারণ হিসেবে সবার উপরে ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ। দু’নম্বরে রয়েছে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি। তিনে ট্র্যাকিয়াল, ব্রঙ্কাস ও লাং ক্যান্সার। চারে স্ট্রোক।
আরও পড়ুন: দু’ দিন পার! এখনও পুরোপুরি নিভল না ঘোলার গেঞ্জি কারখানার আগুন
ব্রাজিল, নরওয়ে, সেনেগাল, আইসল্যান্ড, ডেনমার্কের মতো বেশ কিছু দেশে ধূমপানের হার কমেছে। কিন্তু ১৫১টি দেশে পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেড়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪২টি দেশে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এশিয়া এবং ওশিয়ানিয়াতেই এই ঝোঁক বেশি। ১১৪ কোটি মোট ধূমপায়ীর মধ্যে চিনেরই ৫৫ কোটি। ভারতের ১৩ কোটি, যার মধ্যে পুরুষ ১১ কোটি ৬০ লক্ষ। এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছে মৃত্যুর সংখ্যাতেও।
১৯৯০ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে এই ৩০ বছরে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি চিনে। মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধিতেও। ১৯৯০ সালে চিনে মৃত্যু হয়েছিল ১৫ লক্ষের। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৪ লক্ষ। ভারত এই তালিকায় দ্বিতীয়। সংখ্যাটা ৬ লক্ষ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ লক্ষ। তৃতীয় ইন্দোনেশিয়া।
২০৪টি দেশ জুড়ে সমীক্ষা চালিয়েছে ল্যানসেট। এর মধ্যে মাত্র ৬২টি দেশে ঠিকঠাক ‘স্মোক-ফ্রি’ নীতি রয়েছে। মাত্র ৩৮টি দেশ কর চাপিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণের পথে হেঁটেছে। ল্যানসেটের অভিমত, কর চাপানো নিয়ন্ত্রণের অন্যতম সফল উপায় হতে পারে। কর বাড়িয়ে দিলে দাম বাড়বে। ফলে অনেকেই কিনে ধূমপান করতে পারবেন না। ফলে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমবে।
ভারতের কী করণীয়?
কয়েক দশক ধরে দেশে ‘স্মোক ফ্রি’ নীতির পক্ষে লড়াই চালাচ্ছে ক্যান্সার ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া। প্রশাসনের সঙ্গে এই সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টাতেই একসময় ধূমপান-মুক্ত শহর হয়ে ওঠার লড়াইয়ে নেমেছিল হাওড়া। রাজ্যের অনেক জায়গাতেই এই কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ধুমধাম করে টাস্ক ফোর্স গড়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু কালে কালে সেই উদ্যোগে মরচে ধরে যায়। ক্যান্সার ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার অধিকর্তা সুতপা বিশ্বাস বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান বন্ধ করা জরুরি। আমরা বারবার ওয়ার্কশপ করে সরকারি স্তরে অনেকটাই সচেতনতা আনতে পেরেছি। স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে ধূমপানের প্রবণতা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। তবে অনেক লড়াই বাকি। মাথায় রাখতে হবে, যিনি ধূমপান করছেন, শুধু তিনি নন, প্যাসিভ স্মোকিংও সমান ক্ষতিকারক।’
বিশিষ্ট অঙ্কোলজিস্ট সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘ধূমপানের ফলে শুধু ক্যান্সার নয়, একাধিক রোগ হতে পারে। তাই ধূমপান বন্ধের আবেদন জানিয়ে বহু বছর ধরেই আমরা লড়ছি। কিন্তু এর জন্য সরকারের যতটা সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল, ততটা সক্রিয়তা দেখা যায়নি। সরকার যে আইন করেছে, তা খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে। উত্পাদন যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে কোনও আইন করেই ধূমপান থামানো যাবে না।’