কোভিড যাতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে না পারে তার জন্য দ্রুত ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পাশাপাশি পূর্ণদমে সারা দেশজুড়ে টিকাকরণ নিয়ে বিশাল অভিযানও করে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথমের দিকে ভ্যাকসিন নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও বর্তমানে টিকা নেওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছে।বহু জায়গায় ভ্যাকসিনের ঘাটতির অভিযোগ উঠেছে। আবার অন্যদিকে করোনা ভ্য়াকসিনের ডবল ডোজ নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন বহুজন। শুরু হয়েছে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়েও। এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই সম্প্রতি ভ্যাকসিন ককটেল নিয়ে হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-২ এর মত প্যাথোজেনগুলির উত্স পরীক্ষা করার একটি দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন পদ্মশ্রী ড. রামন গঙ্গাখেদকর। শুধু তাই নয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড কমিউনিকেবল ডিজিজেক প্রাক্তন প্রধান নিউজ নাইনকে একটি সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, কোভ্যাক্সিন সবসময় স্বল্প মাত্রায় সরবরাহ করা হয়েছিল। ভ্যাকসিন তৈরিতে অনেক জটিলতা তৈরি হয়, সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়ায় একটি জীবনদায়ী ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। ভ্যাকসিন ককটেল ও দেশে করোনা পরিস্থিতির উপর নজর রেখে বিভিন্ন প্রশ্নের অকপট উত্তর দিয়েছেন তিনি।
সরকার জানিয়েছে যে বুস্টার বা প্রিক্যশন ডোজ আগের ২টি শটের মতো একই ভ্যাকসিন হবে। যদি বিশেষজ্ঞদের দাবি, একটি ককটেল ভ্যাকসিন এর থেকে আরও বেশি কার্যকর, তাহলে আমরা কেন এর কোনও বিকল্প পথ নিচ্ছি না?
– যে যে দেশ ককটেল ভ্যাকসিনের বুস্টার হিসেবে সমর্থন জানিয়েছে, সেইসব দেশে প্রচুর বিকল্প পথ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকেদের mRNA এবং কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের একটি মাত্র বুস্টার শট দিয়ে টিকা প্রদান করা হয়েচে। যে দুটি পর্যাপ্ত সংখ্যায় মজুত ছিল। কোভ্যাক্সিনের ডোজগুলির তীব্র ঘাটতির কারণে ভারত এটি করতে পারেনি। যেখানে সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া মাসে ১২৫ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করে, সেখানে ভারত বায়োটেক, কোভ্যাক্সিনের প্রস্তুতকার মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করে। আদর পুনাওয়ালা এর আগে জানিয়েছিলেন, সরকারি একটি বুস্টার প্রোগ্রাম ঘোষণা করলে কোম্পানির কাছে ৫০০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন স্টক ছাকবে। তবে প্রবীণদের জন্য প্রিকশ্যন ডোজের জন্য কোভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যাপারে ভারত বায়োটেকের এমন আশ্বাস দেওয়া হয়নি। যদিও আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে ভ্যাকসিনের মিক্সের কার্যকারিতা অনেক বেশি। সরকারের কাথে বুস্টার বা প্রিক্যশন ডোজ হিসেবে একই ভ্যাকসিন বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। আমি খুশি হব যে আমরা কোভ্য়াক্সিন জ্য়াব দিয়ে প্রায় ৪ কোটি মানুষের টিকা দেওয়ার লক্ষ্য পূরণ করা গিয়েছে।
ভারতের প্রথম দেশে উত্পাদিত ভ্যাকসিন (কোভ্যাক্সিন) সর্বদা একটি চলমান গতিতে প্রভাববিত হয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম টিকাদান প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অন্যটি অবশ্যই কোভিশিল্ড। কেন এই অবস্থা?
পুনের ভারত বায়োটেক ন্যাশানাল ইনস্টিটিউড অফ ভাইরোলজি থেকে প্রাপ্ত ভাইরাল স্ট্রেন থেকে কোভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালে চালু করা নতুন সুবিধাগুলি থেকে ডোজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করা হয়। গুজরাতের অঙ্কলেশ্বর থেকে শুধুমাত্র পরিচালনা করতে পেরেছে। তাতে মে মাসে ২০০ মিলিয়ন ডোজ, কর্ণাটক ইউনিটে অগস্টের মধ্যে ৪০-৫০ মিলিয়ন ডোজ দেওয়া হয়েছিল। বায়োটেক অগস্টের শেষে পুনের কাছে প্ল্যান্টে উত্পাদন শুরু করবে বলে আশা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু অনেক পরে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাচগুলি উত্পাদন শুরু করায় পরিস্থিতির অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মোদ্দা কথা কোভ্যাক্সিনের উত্পাদন কখনই যথেষ্ট ছিল না। অন্যদিকে ভারত বায়োটেকের অস্বচ্ছ পদ্ধতির কারণে টিকা সহজলোভ্য ছিল।
এই বিশেষ ভ্যাকসিনের উৎপাদন কম হওয়ার কোনও কারণ আছে কি?
-ভ্যাকসিন তৈরি করা বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি ও বিভিন্ন শহরের অবস্থিত সুযোগ-সুবিধা জড়িয়ে রয়েছে। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী, কাঁচামালের জোগান উত্পাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। কোভ্য়াক্সিন উত্পাদন একটি অনেক জটিল প্রক্রিয়া। এই ভ্যাকসিনে রয়েছে নিষ্ক্রিয়ভ্যাকসিন, যা মৃত করোনাভাইরাস গিয়ে তৈরি করা হয়েছে। শরীরের মধ্যে ইনজেক্ট করলে তা অ্যান্টিবডি তৈরি করে নিরাপদ করে তোলে। ভ্যাকসিনের একটি পর্যায় তৈরির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। এই পদ্ধতিটি দ্রুত করার জন্য যে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর দরকার পড়ে তা আমাদের দেশে নেই। আমরা সাধারণত কোভিশিল্ডের উপর বেশি নির্ভরশীল। এখনও পর্যন্ত যে সব ডোজ দান করা হয়েছে, তার ৪৯ শতাংশেরও বেশি কোভিশিল্ড ভ্য়াকসিন। তুলনায় ভারত জুড়ে মাত্র ১৭ কোটি ৪৮ লক্ষ কোভ্যাক্সিনের শট দেওয়া হয়েছে। মোট টিকা নিয়েছে প্রায় ১৪৮.৬ কোটি মানুষ।
ভারত বায়োটেক ভ্যাকসিনের ৭৮ শতাংশ কার্যকারিতার পরামর্শ দিয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে। শিশুদের জন্য এই শট নেওয়া কি নিরাপদ?
সংস্থাটি ইতোমধ্যে শিশুদের বিভিন্ন গ্রুপের বয়েসের উপর কোভ্যাক্সিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। রেজাল্ট হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, কোভ্যাক্সিনের সঙ্গে টিকা দেওয়ার আগে ও পরে শিশুদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনা করে দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন বয়সের শিশুদের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি করার ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে বেশি। গড়ে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ১.৭ গুণ বেশি নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। মায়োকার্ডাইটিস বা রক্ত জমাট বাঁধার কোনও ঘটনা ট্রায়ালের পরে রিপোর্টে পাওয়া যায়নি। ১৫-১৮ বছর বয়সিদের জন্য কোভ্যাক্সিন নিরাপদ ও তাতে দীর্ঘস্থায়ী কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও থাকবে না।
এপিডেমিওলজিস্টরা সতর্ক করেছেন যে ভাইরাসটি আরও মারাত্মক রূপ নিয়ে তরঙ্গের আকারে দেশের উপর আছড়ে পড়বে। আপনি কি মনে করেন সরকার পরবর্তী পর্যায়ে একটি বুস্টার হিসেবে ভ্যাকসিন ককটেল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে?
– এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিনের ঘাটতি নিয়ে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কোভ্যাক্সিন একটি বুস্টারের জন্য এখনও পর্যাপ্ত উপলব্ধ নয়। কিন্তু উত্পাদন বাড়ানোরও চেষ্টা করা চলেছে। অন্যদিকে কোভিশিল্ড সংক্রমণের তীব্রতা কমাতে ভাল কার্যকরী, তার প্রমাণ মিলেছে। ডিসিজিআই ২টি নয়া ধরনের কোভিড ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। কোভোভ্যাক্স ও করবেভেক্স। নাজাল ভ্যাকসিনের উপরও কাজ করা হচ্ছে। তার গুরুত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। এখন থেকে কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ভ্য়াকসিন থাকবে। এমনও হতে পারে, এর কোনও বিকল্প পথ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।