“পাপ-পুণ্য কোনোটাই তো করার সময় পেলাম না। সারাটা জীবন কেবল ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কি আর ওসব করা যায়?” শিবরাম—থুড়ি শিব্রাম—চক্রবর্তীর মতো ‘সারাটা জীবন’ নয়, তবে টানা ৯০০ ঘণ্টা ‘কেবল ঘুমিয়েই’ কাটিয়ে দিলেন ২৬ বছরের এক বঙ্গতনয়া। আর ‘কেবল ঘুমিয়ে’ কাটালেনই নয়—‘পাপ-পুণ্য’র ঊর্দ্ধে উঠে উপার্জনও করে ফেললেন ৬ লক্ষ টাকা। হ্যাঁ—ঠিকই পড়লেন, ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে ৬ লক্ষ টাকা জিতে গিয়েছেন হুগলির শ্রীরামপুরের বাসিন্দা ত্রিপর্ণা চক্রবর্তী (২৬)।
ভাবছেন এ আর এমন কী আজ? আজকাল তো অধিকাংশই ভুগছেন নিদ্রাহীনতা ( Sleepless Night)-য়। এই প্রজন্মের অভ্যাস রাতে জেগে দিনে ঘুমনো। আর এই কম ঘুমের জন্য একাধিক রোগ-ব্যাধিও জুড়ে বসছে শরীরে। সুগার, ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড… সব কিছুই বাড়ছে হু-হু করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা থেকে মানুষকে সচেতন করতেই Wakefit নামে বেঙ্গালুরুর এক সংস্থা আয়োজন করেছিল এক অভিনব প্রতিযোগিতার: দিনের মধ্যে টানা ৯ ঘণ্টা ঘুমোতে হবে, টানা ১০০ দিন। প্রতিযোগিতার শর্ত ছিল: মাত্র একদিনও যদি এই নির্দিষ্ট সময়ের তুলনায় কম ঘুম হয়, সঙ্গে সঙ্গেই ছিটকে যাবেন সেই প্রতিযোগী। এমনকী পাবেন না কোনও অর্থও।
টাকা রোজগার করার স্বপ্ন তো সকলেরই থাকে। তবে এই রোজগারের রাস্তাটা যে খুব একটা সহজ নয়, তা-ও সকলেই জানেন। প্রচুর পরিশ্রম, ওঠা-পড়া… সব কিছুর মধ্যে দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়। এক রাতে লটারি খুব কম মানুষই টাকা জেতেন। এবং প্রতিযোগিতার শর্ত মেনেই—অর্থাৎ রাতে নয়, দিনে ঘুমিয়েই ৬ লক্ষ টাকা জিতেছেন ত্রিপর্ণা।
সর্বভারতীয় স্তরে আয়োজন করা হয় এই প্রতিযোগিতার। এই নিয়ে দ্বিতীয় বছর এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করল বেঙ্গালুরুর ওই সংস্থা। এবারে নাম লিখিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ প্রতিযোগী। এঁদের মধ্যে থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে বাছাই করে নেওয়া হয় ১৫ জনকে। সেখান থেকে ফাইনালে ওঠেন মাত্র চারজন। ১০০ দিন পর্যন্ত টিকে ছিলেন এঁরাই। ২৪ অগস্ট সংস্থার তরফে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। সেখানেই দেখা যায় শীর্যস্থানে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ত্রিপর্ণা। তাঁর সংগ্রহে ছিল সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট। ১০০-এর মধ্যে ৯৫ পয়েন্ট পেয়েছেন তিনি। প্রথম সিজ়নে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ১ লক্ষ ৭৫ হাজার জন। সেই তুলনায় এ বছরের অর্থাৎ দ্বিতীয় সিজ়নে যোগদানকারীর সংখ্যা দ্বিগুণের থেকেও বেশি।
কীভাবে জানা গেল কে, কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন?
যে চারজন ফাইনালিস্ট হয়েছিলেন, তাঁদের সকলকে একটি গদি এবং ঘুমের ট্র্যাকার দেওয়া হয়েছিল। ঘুমের ট্র্যাকার ছিল স্মার্টওয়াচে। ত্রিপর্ণাকে ১ লক্ষ টাকার মোট ৬টি চেক দেওয়া হয়েছে। ত্রিপর্ণা জানান, একটি ওয়েবসাইট মারফত এই প্রতিযোগিতার খবর জানতে পেরেছিলেন তিনি। বরাবরই রাতে জেগে দিনে ঘুমনো অভ্যাস ত্রিপর্ণার। বর্তমানে তিনি আমেরিকার একটি সংস্থায় কর্মরত—রয়েছেন ওয়ার্ক ফ্রম হোমে। যে কারণে সেই দেশের সময় অনুযায়ী তাঁকে কাজ করতে হয়। আর তাই রাতে জেগে দিনে ঘুমনো অভ্যাস রয়েছে তাঁর। ৬ লক্ষ টাকায় নিজের শখ-আহ্লাদ মেটাবেন—এমনটাই ইচ্ছে ত্রিপর্ণার।
পাশাপাশি একটি সমীক্ষাও সামনে এসেছে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। যেখানে বলা হয়েছে, যে সব স্কুলপড়ুয়া দিনের মধ্যে ৯ ঘণ্টার কম ঘুমোয় তাদের স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা এবং মস্তিষ্কের উপর চাপ পড়ে। তুলনায় যে সব বাচ্চা দিনের মধ্যে অন্তত ১২ ঘণ্টা ঘুমোন, তাঁদের স্মৃতিশক্তি তুলনায় অনেক বেশি প্রখর। এছাড়াও যাঁদের ঘুম প্রয়োজনের তুলনায় কম, হয় তাঁদের মধ্যে অবসাদ, উদ্বেগ এবং আচরণগত কিছু সমস্যা অনেক বেশি হয়। অপর্যাপ্ত ঘুম হলে সেখান থেকে যে স্মৃতিশক্তির ঘাটতি হয়, সেই সম্পর্কে একটি ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথ জার্নাল’-এ।
ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড স্কুল অফ মেডিসিন-এর গবেষকরা ৯-১০ বছর বয়সী ৮,৩০০ জনের উপর সমীক্ষা চালান। সেই বাচ্চাদের মা-বাবার সন্তানের মস্তিস্কের এমআরাই করানো হয়, যাতে বোঝা যায় অভিভাবকদের স্লিপ সাইকেল প্য়াটার্ন কীরকম। তাতেই উঠে এসেছে কম ঘুমের কারণে বাচ্চাদের স্মতিশক্তি এবং বুদ্ধিও ক্রমশ লোপ পাচ্ছে এই কম ঘুমের কারণে। উল্লেখ্য, যে ৮,৩০০ জনের উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে, আগামী তিন বছর অর্থাৎ তাদের ১২ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ফলো-আপ টেস্ট করে যাওয়া হবে।