কুষ্ঠি-ঠিকুজি নয়, বিয়ের আগে প্রয়োজন ডাক্তারি পরীক্ষা, মত চিকিত্‍সকের

বিয়ের আগে কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা করা খুব দরকার। সুস্থ জীবন পেতে একুটু সতর্কতা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলময়। তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়ানো যেতে পারে।

কুষ্ঠি-ঠিকুজি নয়, বিয়ের আগে প্রয়োজন ডাক্তারি পরীক্ষা, মত চিকিত্‍সকের
গ্রাফিক্স- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: May 04, 2022 | 3:24 PM

মনের মিলনই আসল কি না, তা নিয়ে ‘নানা মুণির নানা মত’। তবে বিয়ে যে নিঃসন্দেহে সামাজিক বন্ধন, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। দু’টি মানুষের একসঙ্গে থাকার সামাজিক শিলমোহর। মনের মিলনের চেয়েও যেন পারিবারিক মিলনের বিষয় হয়ে ওঠে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তার পরের ধাপটাই সন্তানের জন্ম। এমন নিয়মই নির্ধারণ করেছে আমাদের সমাজ। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ‘সুখী দাম্পত্য’-এ পা রাখার আগে অনেক পরিবার জ্যোতিষচর্চায় বিশ্বাস রাখে। পাত্র-পাত্রীর ঠিকুজি-কুষ্ঠি বিচার করে। অষ্টকূট মিল হল কি না, মেয়ে মাঙ্গলিক কি না, ঘরে মা-লক্ষ্মীর (পড়ুন স্ত্রী) পদার্পণে শ্রীবৃদ্ধি হবে কি না, সন্তানাদি ক’টি হবে, হলে মেয়ে হবে, না ছেলে হবে… ইত্যাদি-প্রভৃতি।

কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই যা নিয়ে এখনও সচেতনতার যথেষ্ট অভাব, তা হল ডাক্তারি পরীক্ষা। চিকিত্‍সকেরা মনে করেন, সুখী দাম্পত্যের চাবিকাঠি হতে পারে কিছু বেসিক মেডিক্যাল টেস্ট। এই নিয়ে TV9 বাংলা কথা বলল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের প্রফেসর-চিকিত্‍সক তপন নস্করের সঙ্গে। তিনি এই বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস্ দিয়েছেন আমাদের।

প্রফেসর-চিকিত্‍সক তপন নস্কর

প্রশ্ন: বিয়ের আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করা কেন দরকার?

চিকিত্‍সক: দেখুন, একসঙ্গে থাকার আগে কিংবা বিয়ের আগে কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা করা খুব দরকার। আমরা কিছু রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দিই। রুটিন পরীক্ষার মধ্যে হিমোগ্লোবিন, টিসি, ডিসি ছাড়াও আরও কিছু পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়ানো যেতে পারে।

আরও পড়ুন: পার্টনার অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে… তাতে কি আপনি হীনমন্যতায় ভুগছেন? কী বলছেন সেলেব্রিটি-বিশেষজ্ঞ?

প্রশ্ন: আপনি বললেন ‘আরও কিছু পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়’… সেগুলি কী কী?

চিকিত্‍সক: ঠিকুজি-কুষ্ঠির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল ব্লাড-গ্রুপ মেলানো। আমরা বলি এবিও এবং আরএএইচ। এতে কোন গ্রুপের ব্লাড, সেটা জানা যায়। জানা যায় আরএইচ স্ট্যাটাস। অর্থাত্‍, পজ়িটিভ না নেগেটিভ। নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ (O-, A-, B-, AB-)-এর মহিলার সঙ্গে পজ়িটিভ ব্লাড গ্রুপের (0+, A+, B+, AB+) পুরুষের বিয়ে হলে সন্তানের ব্লাড গ্রুপও যদি পজিটিভ হয়, তাহলে বাচ্চাটির রক্তজনিত সমস্যা হতে পারে। সাধারণত প্রথম সন্তানের ক্ষতির মাত্রা কম (যদি স্বামী-স্ত্রী মনে করেন যে তাঁরা সন্তানধারণ করতে চান)। পরবর্তী সন্তানদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্ভাবনা বেশি। অনেক সময় রক্তের সেল ভেঙে যায়, রক্তশূন্যতা তৈরি হয়। সেই জন্য পাত্র-পাত্রীর ব্লাড গ্রুপ জানা খুব জরুরি।

প্রশ্ন: বাবা-মায়ের দু’জনেরই যদি নেগেটিভ কিংবা পজ়িটিভ থাকে, তা হলে কোনও সমস্যা নেই বলছেন।

চিকিত্‍সক: হ্যাঁ। তা হলে কোনও সমস্যা থাকে না। দু’জনেরই পজ়িটিভ বা নেগেটিভ থাকলে পরবর্তীতে সন্তান সুরক্ষিত। এখানে এটা মনে রাখতে হবে, পুরুষের নেগেটিভ ও মহিলার পজ়িটিভ হলেও কোনও সমস্যা নেই।

প্রশ্ন: এই পরীক্ষাগুলির মধ্যে থ্যালাসেমিয়া টেস্টও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়…

চিকিত্‍সক: নিঃসন্দেহে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা। দু’জনের ক্ষেত্রেই জরুরি। থ্যালাসেমিয়া দু’ধরনের হয়—একটিকে ক্যারিয়ার বা বাহক বলি। অন্যটিকে বলি সম্পূর্ণ থ্য়ালাসেমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া মেজর। এটি হলে সন্তানের আয়ু বেশিদিনের জন্য হয় না। অল্পদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয়। রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু যাঁরা ক্যারিয়ার বা মাইনর, তাঁদের বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। তাঁদের রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষের মতোই জীবন অতিবাহিত করেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের চেয়ে হিমোগ্লোবিন কম থাকে তাঁদের শরীরে। যদি দু’জন মাইনর থ্য়ালাসেমিয়া ক্যারিয়ারের বিয়ে হয়, তা হলে ২৫% সম্ভাবনায় তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া মেজর হয়ে জন্মাতে পারে। তাই যাঁরা বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছেন, তাঁদের আমরা বলি থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করানো মাস্ট। যদি দেখি পাত্র-পাত্রী দু’জনেই থ্যালাসেমিয়া মাইনর, পরামর্শ দিই বিয়ে না দিতে। যে কোনও একজন মাইনর হলে, তাঁদের গর্ভজাত সন্তান খুব বেশি হলে থ্যালাসেমিয়া মাইনরই হবে। সাধারণ মানুষের মতো জীবন অতিবাহিত করবে। সেক্ষেত্রে বিয়েটা হতে পারে।

প্রশ্ন: এগুলো তো রক্ত সংক্রান্ত পরীক্ষা। এর সঙ্গে তো নিশ্চয়ই আরও অনেক টেস্ট আছে…

চিকিত্‍সক: আগে এই দু’টি পরীক্ষারই পরামর্শ দিতাম আমরা। কিন্তু এখন আরও কিছু টেস্ট করানোর পরামর্শ দিই। সেগুলি—হেপাটাইটিস বি, হেপিটাইটিস সি ও এইচআইভি। সেই সঙ্গে সুগার টেস্ট করানো ভাল। কারও যদি এইচআইভি পজিটিভ হয় সেই বিয়ে না হওয়াই ভাল। কেননা এইচআইভি সংক্রমিত হবে সন্তানের মধ্যেও। সেটার অনেক সোশ্যাল বার্ডেন আছে। আরও অনেক সমস্যা আছে।

প্রশ্ন: হেপাটাইটিস বি ও সি-এর বিষয়টা যদি স্পষ্ট করেন…

চিকিত্‍সক: হেপাটাইটিস বি সাধারণত যৌনতার রুটে ট্রান্সমিট করে। অর্থাত্‍, যৌন ক্রিয়াকলাপের মারফত ছড়ায়। ফলে বাচ্চাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সন্তানের লিভার খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিয়ের আগে ধরা পড়লে চিকিত্‍সা সম্ভব। হেপাটাইসিস সি-এর কোনও চিকিত্‍সা নেই। তবে সেটার ক্ষেত্রে তেমন অসুবিধাও হয় না। ডরম্যান্ট বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে অনেকসময়।

প্রশ্ন: মহিলা বা পুরুষদের নির্দিষ্ট কোনও টেস্ট আছে?

চিকিত্‍সক: কিছু টেস্ট অবশ্যই আছে। শহরের মহিলাদের ক্ষেত্রে লোয়ার অ্যাবডমেন টেস্ট করানোর পরামর্শ দিই। যেটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় আল্ট্রা সোনোগ্রাফি। জরায়ু বা গর্ভস্থ কোনও ত্রুটি আছে কি না, সিস্ট আছে কি না, দেখে নেওয়ার কথা বলি। পুরুষদের ক্ষেত্রে স্পার্ম কাউন্ট, সিমেন অ্য়ানালিসিস বা বীর্য পরীক্ষা করানো দরকার। এটাই দেখা, বীর্য/শুক্রাণুতে কোনও সমস্য়া আছে কিনা। থাকলে সন্তান হওয়ার ক্ষেত্রে খুব অসুবিধে হতে পারে। অনেক পুরুষ ইগোর কারণে এই পরীক্ষাটি করাতে কুণ্ঠাবোধ করেন। আমার পরামর্শ এটাই, এতে কুণ্ঠাবোধের কোনও কারণ নেই। সুস্থ জীবন পেতে একুটু সতর্কতা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলময়।

অলঙ্করণ- অভীক দেবনাথ