পার্টনার অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে… তাতে কি আপনি হীনমন্যতায় ভুগছেন? কী বলছেন সেলেব্রিটি-বিশেষজ্ঞ?

পরকীয়ার ক্ষেত্রে এক-একজনের এক-একরকম সমস্যা হয়। আমি নিজে ভালভাবে বাঁচব, ছাড়াছাড়ি হলেও আমার সঙ্গীকেও ভালভাবে বাঁচতে দেব—মানসিকভাবে সেই জায়গায় আসতে হবে।

পার্টনার অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে... তাতে কি আপনি হীনমন্যতায় ভুগছেন? কী বলছেন সেলেব্রিটি-বিশেষজ্ঞ?
গ্রাফিক্স- অভিজিৎ বিশ্বাস
Follow Us:
| Updated on: Apr 14, 2021 | 9:34 PM

ঠিক যতটা রোজ়ি অবস্থায় শুরু হয়েছিল, এখন আর সেই জায়গায় নেই সম্পর্ক। অনেকটাই ফিকে হয়েছে গোলাপের রং। কাঁটার খোঁচাটাও যেন বড্ড রক্তাক্ত করছে অন্তরকে। ‘তাহলে কি আমারই দোষে…? নাকি ওঁকে আমিই চিনতে পারিনি?’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেও সুরাহা মেলেনি। ‘ভালবাসা’—শব্দটা যতখানি সহজ, ততখানিই জটিল। শব্দটির সঙ্গে লতাপাতার মতো জড়িয়ে প্রত্যাশা, অভিমানের মতো কিছু লাগামহীন আবেগ। অনেকসময় পাশ কাটিয়ে, চোখ এড়িয়ে চলেও মনের কোণ থেকে নিঃশেষ হতে চায় না। অবাঞ্ছিত হলেও, জীবনের কোনও না-কোনও সময় তাণ্ডব বয়ে আনে এই অনুভূতি। তছনছ করে মন। বারবার মনে হয়, ‘আমারই দোষে…’

‘আমার প্রেম আমার না হয়ে অন্যখানে, অন্য কোনও মনে সাজিয়েছে তার স্বপ্নের ঠিকানা।’ ভালবাসা আমাদের দিয়েই এই কথাগুলো বলায়। এতে কষ্ট অনেক। তুলনায় শান্তি যেন কিছুটা কম। এই পরিস্থিতিতে মনোবিদরা অনেক উপায়ে মনের অবসাদ কাটাতে পারেন। সবচেয়ে সহজ উপায় ‘ফরগিভ, ফরগেট অ্যান্ড গো অ্যাহেড’। তেমনটাই, মনে করেন অভিনেতা ও মনোবিদ সন্দীপ্তা সেন। পার্টনারের অন্যত্র সম্পর্ক থাকলে কী-কী বাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ, তার উপায় TV9 বাংলাকে বললেন সন্দীপ্তা।

প্রশ্ন: পার্টনারের অন্যত্র সম্পর্ক তৈরি হওয়া এখন খুব পরিচিত বিষয়। এতে হীনমন্যতায় ভোগেন অনেকে। একজন মনোবিদ হিসেবে উল্টো দিকের মানুষটিকে কী পরামর্শ দেবেন আপনি?

সন্দীপ্তা: প্রত্যেক মানুষের জীবনের পরিস্থিতি আলাদা, ক্রাইসিস আলাদা। এক্ষেত্রে কারও যদি অন্যত্র সম্পর্ক তৈরি হয়, জানতে হবে বর্তমান সম্পর্কে সমস্যা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তবে এর মানে এটা নয় যে, অপর দিকের মানুষটির মধ্য়ে কোনও সমস্যা আছে বা তার ভিতরে কোনও কিছুর অভাব আছে বলেই পার্টনার অন্য সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। অনেককে দেখেছি বাইরে সম্পর্ক রেখেও বাড়ির মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে চান না। সেক্ষেত্রে বাইরের সম্পর্ককে খুব ক্যাজ়ুয়াল ভাবে নেন সেই ব্যক্তি এবং ভাবতে শুরু করেন এই ধরনের কাজ তিনি করতেই পারেন। এক্ষেত্রে মানুষের বেড়ে ওঠার উপর অনেককিছু নির্ভরশীল। তবে যে কথাটা আমার বলার তা হল, সঙ্গীর অন্যত্র সম্পর্ক হলে নিজেকে ছোটভাবে দেখার মানে নেই। হতেই পারে সম্পর্কটার মধ্যে এমন কিছু সমস্যা ছিল, যার কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কেন সেই সমস্যা হয়েছে, সেটা খুঁজে বের করা প্রয়োজন সবার আগে।

প্রশ্ন: সেটা কেউ খুঁজে বের করবেন কীভাবে?

সন্দীপ্তা: এক্ষেত্রে দু’টি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। কারও যদি কেবল সন্দেহ থেকে হীনমন্যতা তৈরি হয়, তাহলে বিষয়টা আরও জটিল জায়গায় পৌঁছতে পারে। অনেকসময় দেখা গিয়েছে, সন্দেহ করার জন্যও বারবার অপর ব্যক্তি অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। সেটা হয়েছে স্রেফ বিরক্তি থেকে। অর্থাত্‍, মানুষের মধ্যে যখন দূরত্ব তৈরি হয়, কেউ একজন বা দু’জনেই অন্য সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে যান। তাই অযথা সন্দেহ না-করাই ভাল। মানুষ আজকাল একে-অপরকে দোষারোপ করতে এত ব্যস্ত যে, সুস্থ আলোচনা করতে ভুলেই গিয়েছে। আমি বলব, কথা বললে অনেক সময় সমস্যার সমাধান হতে পারে। যে কোনও সম্পর্কের জন্যই সেটা জরুরি।

আরও পড়ুন-তিক্ত সম্পর্কে ফের ভালবাসার আগুন জ্বালাবেন কীভাবে, রইল কিছু টিপস…

প্রশ্ন: কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম থেকে কী-কী বিষয় জরুরি?

সন্দীপ্তা: কোনও সম্পর্কের সমস্যাকে শুরুতেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। জানতে হবে কীভাবে সম্পর্ককে ভাল রাখা যায়। এই প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম। অনেক জায়গায় দেখা যায়, মানুষ অপর মানুষটিকে ‘গ্রান্টেড’ করে নিয়েছে। সেই সময় থেকেই সম্পর্কের ভিত নড়ে যায়। সম্পর্কে থাকা দু’জন মানুষের একে-অপরকে সম্মান দেওয়া প্রাথমিক ক্রাইটেরিয়া। তা না-হলে কোনও সম্পর্কই টিকবে না।

প্রশ্ন: অনেকে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেন। সেটা কতখানি প্রয়োজন?

সন্দীপ্তা: যাঁরা কম্প্রোমাইজ় করে থাকায় রাজি, নিজেরা নিজেদের মতো করে জীবনকে গুছিয়ে নিন। নিজের কাজকর্ম, নিজের চাহিদাগুলো মিটিয়ে নিন নিজের মতো করে। নিজেকে ভালবাসা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমি যতগুলো কেস দেখেছি, পরকীয়ার ক্ষেত্রে এক-একজনের এক-একরকম সমস্যা হয়। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে দেখি মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে যান সঙ্গীর অত্যাচারে। এত জিজ্ঞাসা, এত খবরদারি, সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে। আমার ফোনের পাসওয়ার্ড, ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড আমি নাই-ই শেয়ার করতে পারি। সবাইকে সবকিছু জানাতেই হবে, এমনটা কিন্তু নয়। স্বামী-স্ত্রীর কোনও ব্যক্তিগত বিষয় থাকবে না, সবকিছু অপরপক্ষকে বলতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কিন্তু নেই। সম্পর্কে ‘স্পেস’ দেওয়া খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। না-হলেই অন্য সম্পর্কে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

প্রশ্ন: কেউ যদি জানতে পারে সঙ্গীর অন্যত্র সম্পর্ক আছে, সেই মুহূর্তে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? কারণ প্রথম ধাক্কাতেই মানুষ দিশা হারিয়ে ফেলে।

সন্দীপ্তা: প্রথমেই বলব, প্যানিক নয়। হতাশায় ডুবে যাওয়া নয়। আগে কথা বলা দরকার। কীভাবে কথা বলবেন, তারও পদ্ধতি আছে। দোষ না-দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অনেক বেশি ম্যাচিওরিটি নিয়ে কথা বলতে হবে।

প্রশ্ন: অনেকে এগিয়ে যেতেও ভয় পান…

সন্দীপ্তা: এটা অন্যতম সমস্যা। আমি নিজে এই ধরনের পেশেন্টে পেয়েছি, যাঁদের এই সমস্যা রয়েছে। অনেকে মুভ অন করতে ভয় পান। মনে করেন, ফের যদি আগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। অর্থাত্‍, আত্মবিশ্বাসের অভাব… ভয়। মানসিকভাবে ক্লান্তিভাবও তৈরি হয়। এক্ষেত্রে মনের দরজা খুলে রাখতে বলব। একটা সম্পর্ক টেকেনি বলে অন্যটাও টিকবে না, তেমন যেন না হয়।

প্রশ্ন: অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সমাজের চিন্তাই হয়ে ওঠে প্রধান সমস্যা…

সন্দীপ্তা: সমাজ তো সব ব্যাপারেই অনেক কথা বলে। অনেকবেশি জাজ করে। সমাজের চিন্তা আগেই সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি একজন স্বতন্ত্র মানুষ। আপনার সঙ্গীও তাই। সম্পর্কটা আপনার নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে সমাজের কোনও স্থান নেই। নিজের আত্মবিশ্বাস সর্বপ্রথম। আমি কী চাই, আমি কী বলতে চাই, সেটা পরিষ্কার করতে হবে। মানুষ পরিবর্তনশীল প্রাণী। মনুষ্যত্বের জায়গা থেকে বিচার-বিবেচনা করাও দরকার। আমি নিজে ভালভাবে বাঁচব, ছাড়াছাড়ি হলেও আমার সঙ্গীকেও ভালভাবে বাঁচতে দেব—মানসিকভাবে সেই জায়গায় আসতে হবে। রাগ থাকলে মিটিয়ে ফেলাই ভাল। না হলে শান্তিতে বাঁচা মুশকিল হয়ে উঠবে। আক্রোশ কাটিয়ে ফেলা দরকার। ক্ষমাই পরম ধর্ম। তাই আমি বলব ‘ফরগিভ, ফরগেট অ্যান্ড গো অ্যাহেড’।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস