নয়া দিল্লি: সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনগুলির ফল বেরিয়েছিল ৩ ডিসেম্বর। তারপর, ছত্তীসগঢ়, মধ্য প্রদেশ এবং রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করতে প্রায় নয় দিন সময় নিয়েছে বিজেপি। রবিবার প্রথমে ছত্তীসগঢ়ে বিষ্ণু দেও সাই, তারপর সোমবার মধ্য প্রদেশে মোহন যাদব এবং মঙ্গলবার ভজনলাল শর্মাকে তিন রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করেছে গেরুয়া শিবির। প্রথম জন আদিবাসী সম্প্রদায়ের, দ্বিতীয়জন যাদব, অর্থাৎ, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির এবং তৃতীয় জন ব্রাহ্মণ। তিনটি নাম বাছাই থেকেই স্পষ্ট, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চেয়েছে বিজেপি। তবে, শুধু মুখ্যমন্ত্রীই নয়, তিন রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী এবং বিধানসভার অধ্যক্ষ বাছাইয়ের মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে এই ভারসাম্যের খেলা। লোকসভা নির্বাচনের আগে যা বিজেপির মাস্টারস্ট্রোক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ছত্তীসগঢ়
প্রথমে আসা যাক আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্য ছত্তীসগঢ়ের প্রসঙ্গে। এই রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশই উপজাতি সম্প্রদায়ের। রাজ্যের সুরগুজা এবং বস্তার উপজাতীয় অঞ্চলে ২৬টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২২টিতেই জিতেছে বিজেপি। এরপর আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করা ছাড়া বিজেপির হাতে খুব বেশি বিকল্প ছিল না। তবে, কোনও ওবিসি নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী করেও আদিবাসীদের সন্তুষ্ট করতে পারত বিজেপি। কিন্তু, সেই রাস্তায় হাঁটেনি গেরুয়া শিবির। আসলে, বিষ্ণু দেও সাইকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়ার পিছনে ২০২৪ সালের নির্বাচন একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল।
ছত্তীসগঢ়ের সীমান্তবর্তী রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী জনসংখ্যা যথাক্রমে ২২ এবং ২৬ শতাংশের বেশি। ওড়িশাতে আদিবাসী সম্প্রদায়, সেই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশেরও বেশি। চার রাজ্যের সম্মিলিত লোকসভা আসনের সংখ্যা ৭৫। এর মধ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত ২০টি আসন। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিষ্ণু দেও সাইকে বেছে নেওয়ায়, এই ২০টি আসনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে বিজেপি। বিষ্ণু দেও সাইয়ের ডেপুটি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, ওবিসি নেতা অরুণ সাউ এবং ব্রাহ্মণ নেতা বিজয় শর্মাকে। আর রাজপুত সম্প্রদায়ের রমন সিং দায়িত্ব নিচ্ছেন বিধানসভার অধ্যক্ষের।
মধ্য প্রদেশ
ছত্তীসগঢ়ের মতো, মধ্য প্রদেশেও মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ২০২৪-এর গেমপ্ল্যানকে প্রাধান্য দিয়েছে বিজেপি। মধ্য প্রদেশে, শিবরাজ সিং চৌহানের মতো প্রতিষ্ঠিত নেতা ছিলেন। বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতাও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজেপি বেছে নিয়েছে যাদব সম্প্রদায়ের নেতা মোহন যাদবকে। মধ্য প্রদেশের যাদবরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ছয় শতাংশ। তাই, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একজন যাদবকে বেছে নেওয়া হল কেন, তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
মধ্য প্রদেশে মাত্র ৬ শতাংশ হলেও, বিহারের বৃহত্তম ওবিসি গোষ্ঠী হল যাদবরা, মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশের বেশি। উত্তর প্রদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। তিন রাজ্যে সব মিলিয়ে মোট ১৪৯টি লোকসভা আসন রয়েছে। এর বড় অংশই ওবিসি। তাই মধ্য প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একজন যাদব মুখ, এই তিনটি রাজ্যেই যাদব তথা ওবিসিদের ক্ষমতায়নের বার্তা দেবে বলে আশা করছে বিজেপি। যাদব তথা ওবিসি মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি, উপমুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে, দলিত নেতা জগদীশ দেওড়া এবং ব্রাহ্মণ নেতা রাজেন্দ্র শুক্লাকে। এছাড়া, বিধানসভার অধ্যক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরকে। তিনি ঠাকুর সম্প্রদায়ের।
রাজস্থান
রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ভজনলাল শর্মাকে বেছে নেওয়া সকলকেই অবাক করেছে। তাঁর কোনও মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা নেই, এই বারই প্রথমবার বিধায়ক হয়েছেন। তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রধান দাবিদার ছিলেন বসুন্ধরা রাজে। রাজপরিবারের বংশধর, দুইবারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য বিজেপিতে বিশাল প্রভাব এবং জনগণের পছন্দের ব্যক্তি হওয়ার পাশাপাশি, বসুন্ধরা রাজেকে মুখ্যমন্ত্রী করলে, একজন মহিলাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে পারত বিজেপি। তাহলে, কেন ভজনলাল শর্মাকে বেছে নেওয়া হল?
এর প্রধান কারণ অবশ্যই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মোকাবিলা করা। তবে, তার থেকেও বেশি কাজ করেছে লোকসভা নির্বাচনের গেমপ্ল্যান। রাজস্থানে ব্রাহ্মণরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নয়। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ ব্রাহ্মণ। তবে, প্রতিবেশি উত্তর প্রদেশে ব্রাহ্মণরা জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। হরিয়ানায় প্রায় ১২ শতাংশ। আর মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে প্রায় পাঁচ শতাংশ করে। চার রাজ্যের সম্মিলিত আসন সংখ্যা ১৪৫। এর মধ্যে সাধারণ বিভাগের আসন ১১৪টি। উচ্চবর্ণের নেতা বাছাই এই ১১৪টি আসনকে লক্ষ্য করে বলেই মনে করা হচ্ছে। বাকি দুই রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও উপমুখ্যমন্ত্রী এবং বিধানসভার অধ্যক্ষ বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। দুই উপমুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে, জয়পুর রাজপরিবারের সদস্য তথা রাজপুত সম্প্রদায়ের দিয়া কুমারী এবং দলিত সম্প্রদায়ের প্রেম বৈরওয়াকে। সিন্ধি নেতা বাসুদেব দেবনানিকে করা হয়েছে বিধানসভার অধ্যক্ষ।
‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’
তিন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যেই সাধারণ বিষয় হল, তিনজনেই একেবারে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ঘরের ছেলে। তিনজনেই একেবার ছাত্রজীবন থেকে আরএসএস-এর ছাত্র শাখা এবিভিপির সদস্য ছিলেন। পরে আরএসএস করে তারপর বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কাজেই নতুন মুখ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরএসএস যোগকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা বলাই যায়। তবে, মোদ্দা কথা হল, তিনটি রাজ্যেই সকল সম্প্রদায় ও বর্ণের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চেয়েছে বিজেপি। বিরোধী পক্ষ বারবার জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি তুলছে। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে এই হাতিয়ার অবশ্য কাজে আসেনি। বিরোধীদের সেই প্রচার, বিজেপির এই তিন নয়া মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে আরও ভোঁতা হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’-এর বার্তাও আরও জোরালো ভাবে দেওয়া যাবে।