সেবির পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট থেকে ‘ক্লিনচিট’ মিলেছিল হিন্ডেনবার্গ বিতর্কের আবহে। কিন্তু, বিতর্ক ও আদানি যেন বরাবরাই কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে চলতেই বেশি পছন্দ করে! অগত্যা, নতুন করে মার্কিন বিচার বিভাগের মামলায় নাম জড়িয়েছে খোদ গৌতম আদানির। ভারত তো বটেই গোটা বিশ্বে ফের একবার প্রশ্নের মুখে আদানি গ্রুপের বিশ্বাসযোগ্যতা। কিন্তু, ওই যে রিস্ক হ্যা তো ইস্ক হ্যা! ঝুঁকি আছে, কিন্তু ভালবাসাও আছে। বিতর্ক আছে, সমালোচনা আছে! কিন্তু, সঙ্গে বিনামূল্যেই সীমাহীন চর্চাও আছে, চায়ের ঠেকে জোরদার আলোচনা আছে। আর এই সবটাই যে তাঁদের খুব পছন্দ তা আর একবার যেন বোঝাতে চাইল আদানি গ্রুপ। ঘুরে যাওয়া হাওয়াও যে ঘোরানো যায়, সমালোচনাও যে প্রশংসার রূপ নিতে পারে তা আর একবার প্রমাণ করল আদানি গ্রুপ। হাতিয়ার? অবশ্যই বিজ্ঞাপন।
হাওয়া বদলাচ্ছে আদানির?
‘আগে পাখা আসবে তারপর বিদ্যুৎ’, বাচ্চা ছেলেটা গোটা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলে চলেছে এই একটাই কথা। কিন্তু, বিদ্যুৎ না থাকলে পাখা চলবে কেমন করে? কোন শক্তিতেই বা ঘুরবে তার ডানা? কিন্তু, সদ্য স্কুল যেতে শেখা খুদেটার নাছোড় দাবি, আগে পাখা, তবেই বিদ্যুৎ। কিন্তু, তার কথা শুনে কখনও তাঁর সহপাঠীরা হেসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, তো কখনও আবার স্কুলে বকা খাচ্ছে স্যরের কাছে। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে প্রিয় কুকুরটাকে যে মনের কথা বুঝতে বলবে সেই উপায় কোথায়! যেই না সেই ‘আগে পাথা, পরে বিদ্যুতের’ কথা বলল, সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল কুকুরটাও। একগাদা মন খারাপ নিয়ে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে দেশেরই কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট্ট বাচ্চাটা। মনে প্রশ্ন, তাঁকে বিশ্বাস করার সত্যিই কী কেউ নেই? কিন্তু, ওই যে ধর্মের কল, থুড়ি বিদ্যুতের কল বাতাসে নড়ে! আচমকা দেখল গোটা গ্রাম ছুটে যাচ্ছে গ্রামেরই কোনও এক খোলা প্রান্তরে। ঠিক যেমনটা হীরক রাজার দেশে অত্যাচারি রাজার দড়ি বাঁধা মূর্তিতে টান দিতে ছুটেছিল গোটা গ্রাম! যদিও এখানে কোনও ভাঙার খেলা নেই। শুধুই গড়া। গ্রামবাসীদের মুখে একরাশ স্বপ্ন। একেবারে দিনবদলের। সকলের দৃষ্টি সামনের দিকে। রাস্তাতেই বাচ্চাটাকে দেখতে পেল তার মা। হাত ধরে সামনে নিয়ে ছুট! দূরে দেখা যাচ্ছে এক অদ্ভুত দৃশ্য। যা দেখে হতবাক গোটা গ্রাম। একটা বিশাল সাইজের পাখা বড় বড় ডানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু একটু করে ঘুরছে তার ডানা। আলোয় ভরে যাচ্ছে গোটা গ্রাম। আর সকলে একযোগে বলে উঠছে… ‘আগে পাখা, তারপর বিদ্যুৎ’। হ্যাঁ, ঠিক এই বিজ্ঞাপনেই হাওয়া বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে আদানি। সঙ্গে গ্রিন এনার্জির প্রচারে নতুন ঝড়। এই বিজ্ঞাপন নিয়েই এখন ব্যাপক চর্চা নেটপাড়ায়। বিজ্ঞাপনী কৌশল দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলেই। তবে কী এবার এই ভাবনা ভবিষ্যৎ আদানিদের কাছে? এই ভাবনাকে হাতিয়ার করেই ভাবমূর্তির মৃতপ্রায় কফিন থেকে থেকে পেরক তোলা সম্ভব হবে?
একাধিক বিজ্ঞাপন সংস্থার নামজাদা কর্তারা বলছেন, আদানিরা যে প্রথম বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার করে হারানো গৌরব ফেরানোর চেষ্টা করছেন এমনটা নয়। এরকদম উদাহরণ ভারতের বুকেই রয়েছে অনেক। কখনও অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার অভাব, আবার কখনও অন্যান্য কারণে ব্র্যান্ড ইমেজে প্রভাব! এমনকী সাম্প্রতিককালে দেখা গিয়েছে একাধিক সংস্থার নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের বিক্রি আর্থ-সামাজিক নানা কারণে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। যদিও উল্টো ছবিও দেখা গিয়েছে। ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেই সব সংস্থাগুলি। বড় হাতিয়ার হিসাবে দেখা গিয়েছে বিজ্ঞাপনী রণকৌশল! ম্যাগি থেকে ক্যাডবেরি, কোকাকোলা! তালিকায় কে নেই!
কোমায় গিয়েও বেঁচে উঠেছিল ম্যাগি
২০১৫ সালে ম্যাগিতে অতিরিক্ত সিসা পাওয়ার অভিযোগে নেসলে ইন্ডিয়ার ভাবমূর্তিতে বড়সড় ধাক্কা লাগে। গোটা দেশে খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্যবসা। দ্রুত অ্যাকশন নেয় নেসলে। বিতর্কের আবহে তড়িঘড়ি সমস্ত ম্যাগি নুডলস বাজার থেকে তুলে নেয়। ততক্ষণে বাজারের পিছনের সারিতে থাকা বেশ কিছু নুডলস সংস্থা ম্য়াগির ছেড়ে যাওয়া বাজার ধরার চেষ্টা শুরু করে দেয়। সফলও হয় কেউ কেউ। যদিও ততদিনে ম্যাগির ফিরতি রণকৌশল ঠিক হয়ে গিয়েছে। ‘আবার ম্যাগি ফিরছে’– এই মর্মে একটি প্রচারও চলে। যেখানে গুণমান এবং সুরক্ষার উপর জোর দেওয়ার কথা ফলাও করে বলা হয়। সফলও হয় সেই প্রচার। বর্তমানে ফের নুডলস মার্কেটে এক নম্বরে ম্যাগিই।
একই ধাক্কা সামলাতে হয়েছিল ক্যাডবেরিকেও
২০০৩ সালে ক্যাডবেরির কিছু চকোলেটে পোকা পাওয়া যায় বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে অচিরেই বিক্রি কমে যায়। ঘুরে দাঁড়াতে ফের বিজ্ঞাপনের উপরেই জোর দেয় ক্যাডবেরি। প্যাকেজিং আরও উন্নত করা হয়। এমনভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যাতে পণ্যের উপর ফের ক্যাডবেরি লাভারদের আস্থা ফিরে আসে। দেখা যায় কাজে আসে এই বিজ্ঞাপনী কৌশল। ফের ক্যাডবেরি তাদের হারানো বাজার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
কোন রাস্তায় ফেরে ইমেজ?
ঠিক কোন কোন রাস্তায় কোন নির্দিষ্ট সংস্থার ভাবমূর্তি উদ্ধারের কাজ করে অ্যাড এজেন্সিগুলি? কৌশলগত কী কী পরিবর্তন আনতে হয়? পূর্বে বিজ্ঞাপন সংস্থায় দীর্ঘ সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে যে সমস্ত ব্যক্তিদের তাঁদের অনেকের মতে, যখন ব্র্যান্ড ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় তখন সবার আগে মার্কেট রিসার্চ করে সমস্যার কথা স্বীকার করে নেওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট সংস্থার। এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হল সমস্যাটি স্বচ্ছভাবে স্বীকার করা। যদি ভুল বাড়াবাড়ি রকমের বেশি হয় তাহলে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া, প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া যেতে পারে। তারপরই বলা যেতে পারে নতুন কী পরিকল্পনা তাঁরা করছেন, কেন এরপরেও তাঁদের প্রতি ক্রেতারা বিশ্বাস রাখতে পারেন। সংস্থাটি কীভাবে ব্যক্তি বা সমাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, কীভাবে এতদিন তাঁরা মানুষের পাশে থেকে, কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর-র কাজ করেছেন তাও প্রয়োজনে বলা যেতে পারে। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা সংস্থার প্রতি ফের মানুষের আস্থা ফেরাতে অনেকটা অক্সিজেনের মতো কাজ করে। তা আবার আগেই করে ফেলেছে আদানি গ্রুপ। প্রমাণ তাঁদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে গেলেই স্পষ্ট। এমনকী আদানির হাত ধরে ভারতবাসীর স্বপ্নপূরণ কীভাবে হয়েছে সেই গল্পও বলা হয়েছে বারবার। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে কণ্ঠ শিল্পী হিসাবে সব পরিচিত মুখেদের তুলে আনা হয়েছে।
সবুজ বিদ্যুতে বাড়ছে বরাদ্দ, লাভের গুড় ঘরে তুলতে বদ্ধপরিকর আদানি
এদিকে আবার সবুজ বিদ্যুৎ, অর্থাৎ পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিতে শুরু করেছে কেন্দ্র সরকার। বেড়েছে বরাদ্দ। বিতর্কের আবহে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না, ওয়াকিবহাল মহলের মতে এই ভাবনা থেকেই নতুন করে গ্রিন এনার্জির বিজ্ঞাপনে জোর দিতে চাইছে আদানি গ্রুপ। তাতে পরিবেশ সচেতনতামূলক প্রচার একদিকে যেমন হবে তেমনই আবার সংস্থার প্রোডাক্টের প্রচারও হয়ে যাবে। একইসঙ্গে সামাজিক ও ব্যবসায়িক দায়িত্ব দুই বজায় থাকবে।
এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে তো ইতিমধ্যেই জাতীয় গ্রিন হাইড্রোজেন মিশনের বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ছ’গুণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ছ’শো কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রেও। বাজেটে বরাদ্দ করা একেবারে দশ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এই খাতে যা ছিল তার থেকে ডাবলেরও বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচশো গিগাওয়াট পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ইতিমধ্যেই নিয়ে ফেলেছে ভারত সরকার। তাই আর দেরি করতে চাইছে না আদানিরাও।
ডুবতে থাকা কোকাকোলাকে বাঁচিয়ে ছিলেন ‘বাঙালি’ আমির
তবে শুধু আদানি বা নেসলে নয়, ইমেজ বিপর্যের মুখে পড়তে হয়েছিল বিখ্যাত পানীয় সংস্থা কোকাকোলাকেও। সালটা তখন ২০০৩। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (CSE) নামক একটি অলাভজনক সংস্থার রিপোর্টে কোকাকোলা এবং পেপসির পানীয়গুলিতে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই অভিযোগে দেশজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কোকাকোলার বিক্রিও হু হু করে কমে যায়। এখানেই শেষ নয়। জল ব্যবহার নিয়েও গড়িয়েছিল বিতর্কের জল। কোকাকোলা ভারতে তাদের প্ল্যান্টগুলিতে অতিরিক্ত জল ব্যবহারের জন্য সমালোচিত হয়, বিশেষ করে সেই অঞ্চলে যেখানে জলের অভাব রয়েছে। এর ফলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ তৈরি হয়। তবে এতকিছুর পরেও দমে যাননি সংস্থার কর্তারা।
গুণমান এবং স্বচ্ছতার প্রশ্নে যেখানে সমালোচনার মুখে পড়েছিল সংস্থা, তা দিয়েই ফের হৃতগৌরব ফেরানোর চেষ্টা চলে। কীটনাশকের অভিযোগের পর, কোকাকোলা তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং গুণমান নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি মনোযোগ দেয়। তারা বিভিন্ন প্রচারের মাধ্যমে তাদের পণ্যের সুরক্ষা এবং গুণমান সম্পর্কে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে থাকে। মাঠে নামের আমির খানের মতো বলিউডি স্টার। তাও আবার বাঙালিবাবুর ছদ্মবেশে, কোকাকোলার সঙ্গে বাঙালি সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে। সেই বিজ্ঞাপন এখনও বাঙালির নস্টালজিয়ার পাতায়। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্ক কিছুতেই নেমেন না ধুতি-পাঞ্জাবির আমির। পাশে বসে স্ত্রী বিন্দু কিন্তু যুক্তি দিয়েই যাচ্ছে কেন খাওয়া উচিত। যদিও কিছুতেই তা মানতে নারাজ বাঙালি আমির। যদিও স্ত্রী ছাড়ার পাত্রী নন। তাঁর সাফ যুক্তি কোনও গড়বড় নেই! শুধু ভারতের নয়, বিদেশের ল্যাবেও টেস্ট করে তবেই ফের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কোকাকোলা। কেউ কোথাও কোনও গন্ডগোল খুঁজে পায়নি। শেষ পর্যন্ত গলায় ঠান্ডা কোক ঢালার পর শান্ত হন আমির। ধরেন গান। কোকাকোলার সেই কামব্যাক বিজ্ঞাপন এখনও দোলা লাগায় বাঙালির স্মৃতির পাতায়।
হোমওয়ার্ক আগেই করে রেখেছিল আদানিরা?
কলকাতার এক নামজাদা বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী বলছেন, ব্র্যান্ড ইমেজ পুনরুদ্ধার আসলেই একটি ম্যারাথন দৌড়, কোনও স্প্রিন্ট নয়। এর জন্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিক পদক্ষেপের মাধ্যমে একটানা প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কোকাকোলা যেমন ভারতে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে। যেমন জল সংরক্ষণ, শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রকল্প। বর্তমানে বিনোদন জগতেও তাঁরা পা রেখেছে। ব্রান্ড নেম সামনে রেখে চলে অনুষ্ঠান, হয় কনসার্ট। কিন্তু মূল লক্ষ্য একটাই সঠিক-শক্তিশালি ব্রান্ড ইমেজ আম-আদমির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া।
বিশেষজ্ঞদের স্পষ্ট কথা, জনমানসে আস্থা পুনরুদ্ধারে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের সুর এবং বিষয়বস্তু পরিবর্তন করতে হতে পারে। শুধুমাত্র পণ্যের বৈশিষ্ট্যের উপর মনোযোগ না দিয়ে, সংস্থার মূল্যবোধ, গ্রাহকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বা সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। অনেকেই বলছেন, সেই হোমওয়ার্ক আগেই করে ফেলেছে আদানি গ্রুপ। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনে।