‘দ্যি বেটার’ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত খবর থেকে প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে
কখনও পেটের টানে ভিক্ষে করতে হয়েছে, আবার কখনও তাঁর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যৌনকর্মী হিসেবেও তাঁকে নির্দ্বিধায় কাজে লাগানো হয়েছে। শুধু কী তাই? প্রকাশ্য সমাজের এই লড়াইয়ের সঙ্গেই সমান্তরালভাবে চলেছে মনের ভেতর নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার বৈপরীত্য সামাজিক সমস্যার চেয়েও শতগুনে কঠিন বৈকি!কিন্তু আজ, সেই ‘সুপার হিউম্যান’ কাবেরী উদাহরণ হতে পারেন আরও লক্ষ লক্ষ ‘কাবেরী’র। কারণ এখন তিনি কর্নাটকের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের স্বনির্ভর অটো রিকশাচালক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, উপার্জিত টাকায় আজ শুধু সচ্ছল জীবনই নয়, মাথার উপর পাকা ছাদও টানতে পেরেছেন তিনি।
এই জীবন বৃত্তান্ত কর্নাটকের কাবেরী মেরী ডি’সুজার। উডুপির একটি ছোট্ট শহর পেথ্রিতে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তবে কাবেরী হয়ে নয়, স্ট্যানি ডি’সুজা হয়ে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মের মাধ্যমে জীবন তাঁকে প্রথম ধাক্কাটা দেয়। অর্থ উপার্জনে তাই শৈশবের নরম হাত কেবল শক্ত পেন্সিল ধরতেই কাজে লাগেনি, বরং সেই হাতে বাইতে হয়েছে পরিশ্রমের শক্ত দাঁড়টাকেও। এরপর বয়স যত বেড়েছে ততই কাবেরী বুঝতে পেরেছে, আশেপাশের আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের মত তাঁর জীবন নয়। এই প্রকৃতি তাকে ‘আলাদা’ তৈরি করেছে। তখন দশম শ্রেণির পড়ুয়া স্ট্যানি নিজের শারীরিক গঠন গভীরভাবে বুঝতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই, মনের মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় ঝড়। একটা ট্রেডিশনাল সমাজে নিজের পরিচয় কীভাবে দেবে নিজের? সেই ঝড়ের দাপটে কেবল খেই হারাতে হয়েছে তাঁকে। কারণ তাঁর অনুভূতি বোঝার মত পাওয়া যায়নি কাউকেই।
একটা সময় জীবন এতটাই কঠিন ছিল, পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে কাবেরীকে। একটা কাজ গিয়েছে, আবার খুঁজতে হয়েছে অন্য কাজ। বাড়ি থেকে বহু দূরে মাইশোরে জীবনের একটা বড় সময় কাটাতে হয়েছে। মাথার উপর ছাদ নেই। রাত কেটেছে বাসস্ট্যান্ড অথবা কোনও ছাউনিতে। খিদে-তেষ্টায় নিজের অদৃষ্টকে বারবার দোষারোপ করে কত রাত যে ঘুমিয়ে থাকতে হয়েছে, আজ তার হিসাব করতে পারে না কাবেরী।
এহেন কঠিন সময়ের কিছুটা পরিবর্তন হয়, যখন নিজের মতন কিছু মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় সমাজে। কাবেরীও পেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, তাদের মাঝে খানিক ‘নিজস্বতা’ খুঁজে পান তিনি। কিন্তু জীবনের এই সুখ ‘ইউটার্ন’ নিতে খুব একটা সময় নেয় নি। নিজের মত যাদের খুঁজে পেয়েছিল, এর কয়েকজনের যুক্তিতেই কাবেরী চলে আসে বেঙ্গালুরু। অনেক সোনালী স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল তাঁকে। তৃতীয় ধাক্কা খেতে হয় এখানেই।
বেঙ্গালুরুতে, জীবন ঝলমল করে তো ওঠাইনি। বরং যাদের ভরসায় ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চেয়েছিলেন, সেই তারাই তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে যৌনকর্মী হিসেবে। মনের ভিতরের ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলার ঝড় আর শরীরের উপর পাশবিক আঁচড়, জোড়া ধাক্কা সামলানোর কাজটা মোটেও সহজ ছিল না সেদিন। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? যৌনকর্মে ‘ইস্তফা’ গুঁজে চলে এসেও যে শান্তি নেই! এবার পেটের টানে ভিক্ষা শুরু করতে হলো। এটাই কি জীবন? দুটো খুচরো পয়সার জন্য ট্রাফিক দাঁড়িয়ে নিজের মনকে এই প্রশ্নটাই করেছিল কাবেরী। ঠিক তখন, নিজের মন তাঁকে বলে দেয়, জীবনের সোনালী অধ্যায়টা ঠিক কীভাবে আসতে পারে।
নিজের শহর পেথ্রি-তে ফিরে আসে কাবেরী মেরি ডি’সুজা। ঠিক করেন, আর কাউকে ভরসা নয়। এবার স্বনির্ভর হবেন তিনি। অর্থ উপার্জনের জন্য অটোরিকশা চালাবেন। স্থানীয় একটি মহিলা স্বনির্ভরতা গোষ্ঠীর সহযোগিতায় তিনি একটি অটো কেনেন। এবং কর্নাটকের প্রথম ‘ট্রান্সজেন্ডার’ অটো ড্রাইভার হিসেবে নিজের দৌড় শুরু করেন। এরপর সময়ের সঙ্গে তাঁর অটো ঠিক যতটা পথ অতিক্রম করেছে, ততটাই ভাগ্য বদলেছে কাবেরীর। আজ, আর দুটো টাকার জন্য ট্রাফিক সিগনালে হাত পাততে হয় না তাঁকে। কেউ যৌনকর্মী হওয়ার প্রস্তাব দেন না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অটোর পিক আপে টান দিয়েই উপার্জন করে নেন নিজের স্বনির্ভর জীবনের প্রয়োজনীয় অর্থ।
ক’দিন হল, নিজের বাড়ি হয়েছে কাবেরীর। এক সময় ঝড় বৃষ্টির রাতে পলিথিন অথবা কাপড় জড়িয়ে কাবেরি বাসস্ট্যান্ডে রাত্রিযাপন করতেন। নিজের অদৃষ্টকে দোষারোপ করতে করতে ঘুমিয়েও পড়তেন নিজের অজান্তে। আজ তিনি শান্তিতে দু’চোখের পাতা এক করেন নিজের পাকা ছাদের বাড়িতে। এই কাবেরী কি আরও লক্ষ্য লক্ষ্য ‘কাবেরী’র জন্য রোল মডেল হয়ে উঠতে পারেন না? নিশ্চয়ই পারেন।