নয়া দিল্লি: ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ। এলাহাবাদ হাইকোর্টের দেড়শো বছর পূর্তি উত্সব। অনুষ্ঠানে কাকে, কাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন বিচারপতিরা। বেশ কয়েকজন রাজনীতিককে আমন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই সময় বৈঠকে উপস্থিত প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দিলেন, এটা আদালতের অনুষ্ঠান। এখানে রাজনীতিকদের আমন্ত্রণ করা নিয়ে তাঁর আপত্তি আছে। আদালত আর রাজনীতিকে আলাদা না রাখলে জনমানসে ভুল বার্তা যাবে। আট বছর পর সেই বিচারপতির বাড়ির পুজোয় দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তখন তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি।
এতক্ষণ যাঁর কথা হচ্ছে, তিনি ডি.ওয়াই চন্দ্রচূড়। আরও একজনের কথা বলতে পারি। বিচারপতি অজিত নাথ রায়, বা এ.এন. রায়। ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। অভিযোগ, তিন সিনিয়র বিচারপতিকে টপকে বিচারপতি রায়কে ওই পদে বসানো হয়। এবং সবটাই হয় তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে। তাঁর অবসরের পর সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা লিখিত প্রস্তাব পাশ করেন। এতে বলা হয়েছিল, ভারতীয় আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে কলঙ্কজনক এক অধ্যায় উপহার দিয়ে বিদায় নিয়েছেন বিচারপতি এ.এন রায়।
একটি মামলার শুনানিতে বিচারপতি এ এন রায় বলেছিলেন, “পুলিশ হেফাজত থেকে কেউ নিখোঁজ হলে কার কীই বা করার থাকতে পারে। আর পুলিশ হেফাজতে কেউ মারা গেলে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই ধরতে হবে। পুলিশ কেন কাউকে প্রাণে মারতে যাবে?”। প্রখ্যাত আইনজীবী ননী পাল্কিওয়ালা, শান্তিভূষণ পরে আদালতের কাছে আবেদন করেন, বিচারপতির ওই মন্তব্য সুপ্রিম কোর্টের রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া হোক।
আজ হঠাত্ করে বিচারপতি এ.এন রায়ের কথা উঠল কেন? কারণ দেশের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর মুখে বিগত কয়েকদিন ধরে বারবার এ.এন রায়ের প্রসঙ্গ উঠে আসছে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে ইনিংস শেষ করলেন ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর শেষ কাজের দিন। সরকারি ভাবে রবিবার পর্যন্ত তিনিই প্রধান বিচারপতি। আইনজীবী মহলে তিনি ডিওয়াইসি নামেই তিনি বরাবর পরিচিত। সোশ্যাল মিডিয়া, জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিতে বিদায়ী বিচারপতিকে নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক। টুইটার, ফেসবুকে ট্রেন্ডিং। লক্ষ, লক্ষ কমেন্ট। বেশিরভাগ নেটিজেন চন্দ্রচূড়কে তুলোধোনা করছেন। কেউ, কেউ আবার দারুণ হতাশ। তুলনায় চন্দ্রচূড়ের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিরা আসবেন, যাবেন, এটাই তো নিয়ম। অথচ চন্দ্রচূড়ের বেলায় সেটা হচ্ছে না। সদ্য অবসর নেওয়া প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের লাভা যেন উগরে বেরচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মামলা অসম্পুর্ণ রেখেই বিদায় নিয়েছেন চন্দ্রচূড়। এর মধ্যে রয়েছে আরজিকর মামলা, সরকারি কর্মীদের ডিএ, শিক্ষা দুর্নীতি ও ২৬ হাজার চাকরি বাতিল, ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল সহ আরও কয়েকটা মামলা।
সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে জাতীয় স্তরেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেননি সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। এটাও তো নতুন কোনও ঘটনা নয়। যে কোনও বিচারপতিই তাঁর কাছে থাকা সব মামলা শেষ করতে পারেন না। বিচারপতি চন্দ্রচূড় কোথায় আলাদা হলেন? সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বিচারপতি হিসাবে ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের ট্র্যাক রেকর্ড, তাঁর ভাবমূর্তি, উদার ও স্বচ্ছ মনোভাব – এসব দেখে প্রবল আশাবাদী ছিল সাধারণ মানুষ ও আইনজীবীদের একটি বড় অংশ। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়াতেই সমস্যা। এত ক্ষোভ, এত ট্রোলিং।
সিনিয়র অ্যাডভোকেটরা বলছেন, বিচারপতি চন্দ্রচূড় বেশ কয়েকটি মামলা চেপে দিয়েছেন বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। সেটা অমূলকও বলা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের এক প্রবীণ আইনজীবীর কথায়, “বাংলায় ডিএ মামলার কথাই ভাবুন। বা শিক্ষা দুর্নীতি মামলা। এত গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে এখন কোনও উচ্চবাচ্য শুনতে পান না তো? সবকটাই তো চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে ছিল”।
মণিপুরে হিংসা, তথ্যের অধিকার আইনে সংশোধনী, পেগাসাস কাণ্ড, দিল্লি সরকারের সাংবিধানিক ক্ষমতা – আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দীর্ঘ শুনানি করেছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। রায় দেননি। সংবাদমাধ্যম ও আইনজীবী মহলে তাঁকে যে আলোড়ন, সে ব্যাপারে বিচারপতি চন্দ্রচূড় নিজে কতটা ওয়াকিবহাল? প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিজের মূল্যায়ন কীভাবে করছেন? দুটি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বুঝিয়ে দিয়েছেন, হাজারো সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি নিজের কাজে খুশি। দায়িত্ব পালনে কোনও খামতি ছিল বলে তাঁর অন্তত মনে হয় না। আর সমালোচকদের উদ্দেশ্যেও কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছেন কটাক্ষ।