In depth: ‘হাত’ থেকে কীভাবে ফস্কে গেল হরিয়ানা? জানুন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট

Oct 08, 2024 | 6:37 PM

Haryana Election 2024: হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর, অধিকাংশ সমীক্ষা সংস্থাই জানিয়েছিল, এবারের ভোটে আরামদায়ক জয় পেতে চলেছে কংগ্রেস। এদিন ফলাফলের একেবারে প্রাথমিক প্রবণতাতেও অনেকটাই এগিয়ে ছিল কংগ্রেস। কিন্তু, সময় যত এগিয়েছে ততই স্পষ্ট হয়েছে হরিয়ানায় টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি। কীভাবে বিজেপি এই অসাধ্য সাধন করল। কীভাবে কেড়ে নিল কংগ্রেসের মুখের গ্রাস?

In depth: ‘হাত’ থেকে কীভাবে ফস্কে গেল হরিয়ানা? জানুন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট
রাহুলের 'হাত' থেকে ফস্কে গেল হরিয়ানা, কী জাদু করলেন মোদী?
Image Credit source: TV9 Bangla

Follow Us

বলা হয়, ক্রিকেট এক বলের খেলা। শেষ বল না হওয়া পর্যন্ত ম্যাচ শেষ বলে ধরা যায় না। নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেটা সত্যি। যে কোনও সময় যে কোনও দিকে ঘুরে যেতে পারে খেলা। মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর), হরিয়ানার ভোটের ফল তার আরও একবার এই কথাটা প্রমাণ করে দিল। হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর, অধিকাংশ সমীক্ষা সংস্থাই জানিয়েছিল, এবারের ভোটে আরামদায়ক জয় পেতে চলেছে কংগ্রেস। এদিন ফলাফলের একেবারে প্রাথমিক প্রবণতাতেও অনেকটাই এগিয়ে ছিল কংগ্রেস। কিন্তু, সময় যত এগিয়েছে ততই স্পষ্ট হয়েছে হরিয়ানায় টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি। শুধু তাই নয়, ১০ বছরের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়ার মধ্যেও তাদের ফল গতবারের থেকেও ভাল হচ্ছে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদল এবং নির্দলদের সমর্থনে সহজেই সরকার গঠন করতে পারবে তারা। প্রসঙ্গত, ১৯৬৬ সালে পঞ্জাব থেকে আলাদা হওয়ার পর, হরিয়ানায় একটানা কোনও দল তিনবার জিততে পারেনি। তাই এই জয়, আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে বিজেপি এই অসাধ্য সাধন করল। কীভাবে কেড়ে নিল কংগ্রেসের মুখের গ্রাস?

জাঠ ফ্যাক্টর

ভোটের আগে থেকেই জাঠ সম্প্রদায় ঢেলে কংগ্রেসকে ভোট দেবে বলে মনে করছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন হয়েছে। যৌন হেনস্থার অভিযোগ সামনে রেখে আন্দোলন করেছেন কুস্তিগীররাও। দুই আন্দোলনেই অগ্রগামী ভূমিকায় ছিল জাঠ সম্প্রদায়। তবে, জাঠ ভোট কংগ্রেসের পক্ষে আসছে, এই হাওয়া ওঠার অনেক আগে থেকেই, এর একটা দাওয়াই-ও বের করেছিল বিজেপি। সেই ২০১৪ সাল থেকেই প্রভাবশালী জাঠ সম্প্রদায় বিরুদ্ধে বিজেপি দাঁড় করিয়েছিল রাজ্যের আরও ৩৫টি সম্প্রদায়কে। সেই সময় থেকেই বিজেপির স্লোগান ছিল “৩৫ বনাম ১”। অ-জাঠ সম্প্রদায়গুলিকে এক জায়গায় এনে এর আগের দুইবারও জয়লাভ করেছিল তারা। এবারেও সেই ফর্মুলাই কাজে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থাৎ, কংগ্রেসের যেভাবে জাঠ ভোটের মেরুকরণ করেছিল, তার পাল্টা মেরুকরণের রাজনীতি করেছে বিজেপিও।

জাঠ ভোট পায়নি কংগ্রেস

শুধু বিজেপির এই কৌশল কাজ করেছে, তাও নয়। জাঠদের ভোট শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পেয়েছে, তাও মনে করছেন না নির্বাচনী বিশ্লেষকরা। এখনও পর্যন্ত ভোটের ফলের যে প্রবণতা, তাতে জাঠ অধ্যুষিত ৩৬টি আসনের মধ্যে ১৯টিতেই এগিয়ে রয়েছে বা জয় পেয়েছে বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের সময়, এই বিধানসভা এলাকাগুলির ২৭টিতে এগিয়ে ছিল কংগ্রেস। জাঠ নেতা ভূপিন্দর সিং হুডার নেতৃত্ব তার পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এবার তাহলে কেন সেই ফর্মুলা কাজ করল না? অনেকেই মনে করছেন, এর প্রধান কারণ বিজেপির প্রাক্তন মিত্র, দুষ্মন্ত চৌটালা। তাঁর জননায়ক জনতা পার্টি এবার একটি আসনও জিততে না পারলেও, কংগ্রেসের জাঠ ভোটব্যাঙ্কে বড় ভাঙন ধরিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জেজেপি ভোট ব্যাঙ্কে ধস

নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে, বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল জেজেপি। এরপর, তারা বিজেপির ভোট ব্যাঙ্কে আঘাত করবে বলে মনে করেছিলেন রাজনৈতিকর বিশ্লেষকরা। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। একদিকে যেমন জেজেপি কংগ্রেসের ভোট কেটেছে, অন্যদিকে, তাদের ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামিয়েছে বিজেপি। গত নির্বাচনে জেজেপি ১০টি আসন জিতেছিল। তারাই ছিল কিংমেকার। তবে, এবার এখন পর্যন্ত যা প্রবণতা, তাদের একটি আসনও জেতার সম্ভাবনা নেই।

শহুরে ভোট ব্যাঙ্ক

হরিয়ানার গত দুই বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচনে বিজেপির জয়ের পিছনে অন্যতম ফ্যাক্টর ছিল শহরাঞ্চলের ভোট। বিশেষ করে দক্ষিণ হরিয়ানার আহিরওয়াল বেল্টের শহুরে ভোটাররা বরাবর বিজেপির অনুগত ভোটার ছিলেন। এবারেও তাতে ভাটা পড়েনি। এখনও পর্যন্ত ফলাফলের যা প্রবণতা, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই এলাকার ১১টি বিধানসভা আসনে শুধুই গেরুয়া পতাকা উড়ছে। লোকসভা নির্বাচনেও, এই ১১টি বিধানসভা এলাকার মধ্যে ১০টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। শুধু আহিরওয়ালই নয়, গুরুগ্রামের শহুরে ভোটাররাও বিজেপিকেই আশীর্বাদ করেছে।

কংগ্রেসের আত্মতুষ্টি

দ্বিতীয় বড় কারণ, কংগ্রেসের আত্মতুষ্টি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। লোকসভা ভোটের ফল এবং সেই সময় জাঠরা যেভাবে ঢেলে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিল, তাতে জয়ের বিষয়ে কংগ্রেস নেতারা আত্মতুষ্ট হয়ে পড়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। যেখানে নায়েব সিং সাইনির নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছে বিজেপির কর্মীরা, সেখানে আত্মতুষ্ট কংগ্রেস সেভাবে লড়াই ধরে রাখতে পরেনি বলে মনে করা হচ্ছে। ঠিক যেরকমটা ঘটেছিল গত বছর ছত্তীসগঢ় নির্বাচনে। জয়ের বিষয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়েছিল রাজ্যটি।

কংগ্রেসের গোষ্ঠী কোন্দল

এর সঙ্গে রয়েছে কংগ্রেসের গোষ্ঠী কোন্দল। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেলের মতোই, বুথ ফেরত সমীক্ষায় কংগ্রেসের জয়ের ইঙ্গিত পেতেই, কে মুখ্যমন্ত্রী হবে, সেই দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছিল। হরিয়ানার দাপুটে মন্ত্রী অনিল ভিজ মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইলেও, বিজেপি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, নায়েব সিং সাইনিই তাদের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ। সেই অর্থে, তাঁর কোনও ঘনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু, প্রচুর সমস্যা ছিল হাত শিবিরে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিরোধী দলনেতা, ভূপিন্দর সিং হুডা ছিলেন সবথেকে বড় দাবিদার। দৌড়ে ছিল, দলিত নেত্রী কুমারী সেলজা, রণদীপ সুরজেওয়ালা এবং ভূপিন্দরের সিং হুডার ছেলে দীপেন্দর হুডার নামও। জানা গিয়েছে, ভূপিন্দর হুডা নিজে তাঁর ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। আর তাই যোগ্য প্রার্থী বদলে, অনুগতদের প্রার্থী করার দিকে বেশি মন দিয়েছিলেন। ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৭২টিতেই কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন ভূপিন্দর অনুগতরা।

রাহুল-প্রিয়াঙ্কার অভাব

একই সঙ্গে চলে আসে রাহুল গান্ধী-প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর অভাবের কথা। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পুনরুত্থানের পিছনে এই ভাই-বোনের বড় ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে, দিল্লি-হরিয়ানা-উত্তর প্রদেশে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বিপুল জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু, জম্মু-কাশ্মীরকে তারা যতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন, ততটা হরিয়ানাকে দেননি বলে মনে করে খোদ হরিয়ানার কংগ্রেস কর্মীরাই। আসলে ভূপিন্দর সিং হুডার নেতৃত্বের উপর অতিরিক্ত আস্থা রেখেছিলেন রাহুল। হরিয়ানার বেশ কিছু সভা করেছেন তিনি। অগ্নিবীর প্রকল্প থেকে বেকারত্বের মতো ইস্যুগুলিকে সামনে এনেছেন। কিন্তু, এই বিষয়গুলিকে ভোট ব্যাঙ্কে লাভের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস।

মুখ্যমন্ত্রী বদল

গত বছর থেকেই একের পর এক রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে বিজেপি। হরিয়ানাও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, বর্ষীয়ান নেতা মনোহরলাল খট্টরকে সরিয়ে তরুণ নেতা নায়েব সিং সাইনিকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল। মনোহর লাল খট্টরকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হয়। মনোহরলাল খট্টর প্রায় ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাই যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছিল, তা ছিল মূলত খট্টর সরকারের বিরুদ্ধে। তাঁকে সরিয়ে সাইনিকে মুখ্যমন্ত্রী করাটা যে মাস্টারস্ট্রোক ছিল, তা এদিনের ফলেই প্রমাণিত।

মোদী ফ্যাক্টর

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর, বিজেপির সমালোচকরা দাবি করেছিলেন, ফিকে হয়ে যাচ্ছে ‘মোদী ফ্যাক্টর’। বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু, হরিয়ানা নির্বাচনের ফলাফল কিন্তু বলছে ‘মোদী ফ্যাক্টর’-এর প্রভাব এখনও অক্ষত। হরিয়ানায় ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’-এর কাজগুলিকেই তুলে ধরেছিল বিজেপি। মোদী সরকারের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প, বিভিন্ন পদক্ষেপকে সামনে রেখেই প্রচার চালানো হয়েছিল।

শেষ কথা

তবে, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলেও, জমি ছাড়েনি কংগ্রেসও। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাদের যে চমকে দেওয়া পুনরুত্থান দেখা গিয়েছিল, সেই ধারা কিন্তু এখনও অব্যাহতই বলা যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর, একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা ভোটে ধুয়ে মুছে গিয়েছিল কংগ্রেস। কাপ আর ঠোঁটের দূরত্বটা না ঘোচাতে পারলেও, এবারের ভোটে হাত শিবির কিন্তু দাগ কেটেছে।

Next Article