ভারত যে নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরি করতে চলেছে, সেখবর ইসরো জানিয়েছে। বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। এবার ইসরো জানিয়ে দিল, ভারতের স্পেস স্টেশন ভারতের হলেও তার সুফল পাবে সারা দুনিয়া। কারণ এখন লোয়ার আর্থ অরবিটে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন যেমন আছে। ভারতের স্পেস স্টেশন ঠিক সেই একইরকম পজিশনে থাকবে। এজন্য ইসরোকে বাড়তি কিছুটা কাঠখড় পোড়াতে হবে। তবে, সারা পৃথিবীর স্বার্থে তারা সেই পথেই হাঁটবে।
আমরা জানি পৃথিবী যখন সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তখন সে সাড়ে ছেষট্টি ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে। একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন যখন পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, তখন সে ৫১.৬ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে। ভারতের স্পেস স্টেশনের ইনক্লাইনেশন অলমোস্ট তার সমান, ৫১.৫ ডিগ্রি হবে বলে জানিয়ে দিল ইসরো। এর আবার বেশ কয়েকটা দিক আছে। এখন বিভিন্ন দেশের মহাকাশযান যেরকম হিসেব কষে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে দাঁড়ায় তাতে যতটা ফুয়েল পোড়ে ভবিষ্যতে তারা যদি ভারতের স্পেস স্টেশনে আসতে চায়, তাহলে তাদের বাড়তি কোনও ঝামেলা পোহাতে হবে না। কারণ, দুটো স্পেস স্টেশনেরই ইনক্লাইনেশনটা এক থাকছে। আবার, স্পেস স্টেশন ৫১.৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে হেলে থাকলে সে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ জায়গার ওপর নজর রাখতে পারবে। ফলে এতে সব দেশেরই লাভ।
সেদিক থেকেও দেখলেও ভারতের স্পেস স্টেশন, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের বিকল্প হতে চলেছে। স্পেস স্টেশনের সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব দেশের গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোর কমিউনিকেশন সিস্টেমেও কোনও পরিবর্তন হবে না। তবে ইসরো কাঠখড় পোড়াবে কেন? বিজ্ঞানী-গবেষকরা বলছেন, রাশিয়া যখন বৈকানুর কসমোড্রোম থেকে কোনও মহাকাশযান পাঠায়। তখন বৈকানুরের অক্ষাংশের জন্য এই ৫১.৫ ডিগ্রি ইনক্লাইনেশনে পৌঁছতে তাদের কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু ভারতের মাটি থেকে উত্ক্ষেপণের পর স্পেস স্টেশনকে কক্ষপথে এই অ্যাঙ্গেলে রাখতে গেলে অনেক জটিল অঙ্ক কষতে হবে। অনেকগুলো ম্যানুভার লাগবে। আর এতে ফুয়েল খরচ হবে অনেক বেশি।
কিছুদিনের মধ্যেই গগনযানে চেপে ৩ ভারতীয় মহাকাশচারী পাড়ি জমাবেন মহাকাশে। পরের কাজটা হল ভারতীয় মহাকাশচারীরা যাতে দীর্ঘসময় ধরে মহাকাশে থাকতে পারেন তার ব্যবস্থা করা। সেটাই সম্ভব হবে যদি আমাদের নিজেদের একটা স্পেস স্টেশন থাকে। কারণ পৃথিবীই বলুন বা মহাকাশ। ভাড়া বাড়ির বদলে নিজের বাড়ি থাকলে সবসময়েই সুবিধা। ভাড়া বাড়ি অর্থাৎ বর্তমান আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। আগামিদিনে মহাকাশ বাণিজ্যে বিপুল লাভের আশা দেখে প্রাইভেট স্পেস স্টেশন তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। অ্যাক্সিওম স্পেস, স্ট্যারল্যাব -এই সব বিভিন্ন নামও শোনা যাচ্ছে। রেস শুরুর সময়ই ভারতকে যদি স্টার্টিং পয়েন্টে দেখতে পাওয়া যায়। তাহলে এর চেয়ে ভালো কথা আর কী হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। এই স্পেস স্টেশন হল মানুষের মহাকাশে পাঠানো সবচেয়ে বড় অবজেক্ট। আয়তন একটা ফুটবল মাঠের সমান। ১৯৯৮ সালে তৈরি হয়। তখন থেকেই লোয়ার আর্থ অরবিটে এটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এখনও পর্যন্ত ২০ দেশের আড়াইশোর বেশি নভশ্চর এখানে থেকে এসেছেন। কিন্তু কথা হল, এই স্পেস স্টেশনের যন্ত্রপাতি সব পুরনো হয়ে গেছে। এটাকে এবার নামিয়ে আনতে হবে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন ২০৩১ সালের মধ্যেই স্পেস স্টেশনটিকে ধ্বংস করে দিতে হবে। নাহলে সেটি কক্ষচ্যুত হয়ে মহাকাশে এলোমেলো ঘুরতে থাকবে। তখন কোনও কৃত্রিম উপগ্রহ বা কোনও মহাকাশযানের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে বিপর্যয় ঘটে যাবে। ঠিক হয়েছে যে স্পেস স্টেশনটিকে ডি-অরবিট করার কাজ ২০২৬ সালেই শুরু হয়ে যাবে।
প্রোগ্রেস নামে রাশিয়ার তৈরি যান সেটিকে ঠেলে বায়ুমণ্ডলের কাছাকাছি নামিয়ে আনবে। এর পর মাধ্যাকর্ষণকে ব্যবহার করে ৪০০ টন ওজনের এই জিনিসটাকে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে প্রশান্ত মহাসাগরে এনে ফেলা হবে। বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে স্পেস স্টেশনের অধিকাংশই অবশ্য জলে পড়ার আগেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আপনাদের বলে রাখি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন মূলত চালায় মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও রুশ মহাকাশ সংস্থা রসকসমস। মহাকাশ কেন্দ্রের লে-আউট রাশিয়ার হাতে। রক্ষণাবেক্ষণের ভারও পুতিনের দেশের ওপর। আবার এখান থেকে উপগ্রহ ও মহাকাশযানগুলির ওপর নজরদারির দায়িত্ব আমেরিকার কাঁধে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে আমেরিকা ও রাশিয়া একমত না হলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র নিয়ে এক পাও এগোনো সম্ভব নয়। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে এই মুহূর্তে দুই দেশের মুখ দেখাদেখিই বন্ধ। ফলে সময় থাকতে এখনই আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের বিকল্প সব দেশকে ভাবতে হবে। আর সেই বিকল্পটাই হতে চলেছে ভারতের স্পেস স্টেশন।