ভোপাল: সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে তিন রাজ্যে জয় পেয়েছে বিজেপি। ছত্তীসগঢ় এবং রাজস্থান রাজ্যের ক্ষমতা তারা কংগ্রেসের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে, ক্ষমতা ধরে রেখেছে মধ্য প্রদেশে। বিশেষ করে ছত্তীসগঢ়ের ফলাফল চমকে দিয়েছে রাজনৈতিক মহলকে। সবকটি জনমত সমীক্ষা এবং বুথ ফেরত সমীক্ষা রাজ্যে পালা বদলের ইঙ্গিত দিযেছিল, কিছু না হলেও, কংগ্রেস-বিজেপি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে রাজ্যের ২৩০ বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৬৩টি আসন জিতেছে বিজেপি। রাজ্যের ইতিহাসে বিজেপির পক্ষে সবথেকে ভাল ফল। অনেকেই দাবি করেছেন, এই ফলের পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে শিবরাজের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির। তারপরও মুখ্য়মন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল শিবরাজ সিং চৌহানকে। তাঁর বদলে মুখ্যমন্ত্রী করা হল মোহন যাদবকে। কিন্তু, কেন রাজ্যে দলকে এত ভাল ফল দেওয়ার পরও শিবরাজ জমানার অবসান ঘটাল বিজেপি?
প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা
চলতি বছরের নির্বাচনে শিবরাজ সিং চৌহানের সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। দীর্ঘ মেয়াদী যে কোনও সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ২০০৫ সাল থেকে শিবরাজ প্রায় একটানা রাজ্যের ক্ষমতায় ছিলেন। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মধ্য প্রদেশে সরকার ভাল কাজ করলেও, উল্লনিতর অনেক জায়গা রয়েছে। চলতি বছরের নির্বাচনে, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কারণেই রাজ্যে তাঁর তথা বিজেপির জেতা অনিশ্চিত বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল সমীক্ষাকারী সংস্খাগুলি। শেষ পর্যন্ত, ভোটের ফলে সেই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ছাপ পড়েনি । তবে, তাই বলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা নেই, এই কথা বলা যাবে না। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার জেরেই হারতে হয়েছিল বিজেপিকে। জয়ের আনন্দের কার্পেটের নীচে, এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সমস্যাকে লুকিয়ে ফেলতে নারাজ বিজেপি। শিবরাজ সিং চৌহানকে সরিয়ে দেওয়া, এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
জনপ্রিয়তা হ্রাস
মধ্য প্রদেশে বিপুল জয়ের পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে শিবরাজের নেতৃত্বকে তুলে ধরা হলেও, বিভিন্ন সমীক্ষক সংস্খার প্রতিবেদনে ধরা পড়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্রমে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন শিবরাজ। ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ৪০-এর ঘরের মাঝামাঝি। ২০২৩-এ তা ৪০-এর নীচে নেমে এসেছে।
নতুন মুখ
বর্তমানে শিবরাজ সিং চৌহানের বয়স ৬৪ বছর। এইবারও যদি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা হত, সেই ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে তাঁর বয়স দাঁড়াতো ৬৯। কাজেই, রাজ্যে তাঁর বিকল্প মুখ খুঁজতেই হত বিজেপিকে। হয়তো ৫ বছরের মেয়াদের মাঝে কোনও এক সময় তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যেত। যেই রকমটা এর আগে কর্নাটকে করা হয়েছিল। বিএস ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে বাসবরাজ বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। কিন্তু, সেই ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল, নতুন মুখ্যমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য যথেষ্ট সময় ছিল না। তাই এই ক্ষেত্রে, একেবারে মেয়াদের শুরুতেই নতুন এক মুখকে দায়িত্ব দেওয়া হল।
তাজা বাতাস
জাতীয় রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে বিজেপি ছাড়া প্রায় প্রতিটি দলই উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভুগছে। বিজেপি নিরন্তর, নতুন নতুন ব্যক্তিদের নয়া নয়া দায়িত্ব দিয়ে চলেছে। যার জেরে, বিজেপির পরবর্তী প্রজন্মের নেতারাও ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতা ধরেই শিবরাজ সিং চৌহানের বদলে, নতুন নেতা তুলে আনল গেরুয়া শিবির। নতুন নেতা যে কোনও দলেই তাজা বাতাসের মতো। তাদের হাত ধরে অনেক নতুন ভাবনাও আসে।
কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে?
গুঞ্জন রয়েছে, শিবরাজ সিং চৌহানকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় স্থানান্তর করা হতে পারে। এমনকি, দলেও আরও বড় ভূমিকায় দেখা যেতে পারে তাঁকে। লোকসভা নির্বাচনের পরই জাতীয় সভাপতি হিসেবে জেপি নাড্ডার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, শিবরাজ চৌহানকে দলের জাতীয় সভাপতিও করা হতে পারে। তাঁর দীর্ঘ নির্বাচনী অভিজ্ঞতাকে এখন জাতীয় স্তরে কাজে লাগাতে পারে বিজেপি।
লক্ষ্য ২০২৪
বিজেপি-র এখন মূল লক্ষ্য ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজয়। আর এই ক্ষেত্রে শিবরাজ সিংয়ের মতো অভিজ্ঞ নেতা বড় ভূমিকা নিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে থাকলে, লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বেশি সময় দিতে পারতেন না শিবরাজ সিং চৌহান। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব না থাকলে, অনেক বেশি ভারমুক্ত হয়ে, লোকসভা নির্বাচনে প্রচারে নামতে পারবেন তিনি। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মধ্য প্রদেশ থেকে যত বেশি সম্ভব আস জয় লক্ষ্য় বিজেপির।
নেতা নয়, দলই বড়
সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে বিজেপিকে এক নয়া কৌশলে ভোট লড়তে দেখা গিয়েছে। এর আগে, রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনে লড়লেও, এই ৫ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে একটি রাজ্যেও আগে থেকে মুখ্যমন্কত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করেনি বিজেপি। মনে করা হচ্ছে, ধীরে ধীরে ভোট লড়ার কৌশল বদলাতে চাইছে বিজেপি। নেতা নয়, দল ও দলের নীতিই বড়, ভোটারদের এই বার্তা দিতে চাইছে। মধ্য প্রদেশে শেষ পর্যন্ত শিবরাজ সিং চৌহানকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলে, নির্বাচনী সাফল্যে তাঁর ভূমিকাই সবথেকে বড় হয়ে ধরা পড়ত। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী না করে, এই সাফল্যকে কোনও নির্দিষ্ট নেতার নয়, দলের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইছে বিজেপি।