নয়াদিল্লি: অর্থনীতির অধ্যাপক। মিতভাষী। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর তেমন সম্পর্কই ছিল না। সেই তিনিই পরে ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর হাত ধরেই উদার অর্থনীতির দরজা খোলে ভারতে। ৯২ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
জন্ম ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। পশ্চিম পঞ্জাবের গেহ-তে। যা বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার ভারতে চলে আসে। পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী। অক্সফোর্ড থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জে কাজ করেন।
একসময় পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়েও অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অর্থনীতিতে তাঁর দক্ষতা নজর কাড়ে তৎকালীন মিনিস্ট্রি অব ফরেন ট্রেডের মন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্রের। মনমোহন সিংকে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন। তারপরই কেন্দ্রের অলিন্দে ছড়িয়ে পড়ে মনমোহন সিংয়ের নাম।
১৯৭২ সালে অর্থমন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয় তাঁকে। চার বছর পর হন অর্থমন্ত্রকের সচিব। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত যোজনা কমিশন এবং ১৯৮২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গর্ভনর নিযুক্ত হন তিনি। সেইসময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন মনমোহন সিং। যোজনা কমিশনের মেয়াদ শেষে জেনেভা পাড়ি দেন তিনি। সাউথ কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব নিয়ে ভারত ছাড়েন। ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯০ সালের নভেম্বরে জেনেভা থেকে ভারতে ফিরে আসেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখরের অর্থনৈতিক বিষয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালের মার্চে ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
এতদিন পর্যন্ত দিল্লির অলিন্দে নানা দায়িত্ব পালন করলেও রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল না মনমোহন সিংয়ের। কিন্তু, ১৯৯১ সালের জুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও তাঁকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসেন। একদম অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বে। বদলে যায় ভারতের অর্থনীতির মানচিত্রও। মনমোহন সিংয়ের হাত ধরেই উদার অর্থনীতিতে প্রবেশ ভারতের।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার চার মাস পর অসম থেকে কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ হন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অসম থেকে রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। তারপর রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। বয়সজনিত কারণে রাজনীতির আঙিনায় আর সেভাবে তাঁকে দেখা যেত না।
তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়াকেও অনেকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ বলে বর্ণনা করেন। ২০০৪ সালে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার গঠন হয়। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। শেষপর্যন্ত ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধী মনমোহন সিংয়ের নাম ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালে ইউপিএ ফের ক্ষমতায় আসার পর তাঁর উপরই আস্থা রাখে কংগ্রেস। ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। কিন্তু, তাঁকে কংগ্রেসের কাঠপুতুল বলে একাধিকবার খোঁচা দিয়েছে বিরোধীরা। তবে নীরবে নিজের কাজ করে গিয়েছেন বিশ্বখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ। আর এদিন কয়েকঘণ্টা হাসপাতালে চিকিৎসার পর না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন ভারতের ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’।