কমলেশ চৌধুরী: গোটা দেশ যখন ইংরাজি নববর্ষ উদযাপনের জন্য তৈরি হচ্ছে, দুঃসংবাদ এসেছিল ঠিক তখনই। দুনিয়া জুড়ে শোরগোল ফেলে দেওয়া বিলিতি করোনা (COVID) স্ট্রেনের প্রথম খোঁজ মিলেছিল দেশে। আশার কথা, সেই ২৯ ডিসেম্বরের পর দেড় মাস পেরোলেও ‘অতি সংক্রামক’ ব্রিটিশ স্ট্রেনের জন্য নতুন করে চোখের জল ফেলতে হয়নি ভারতকে। কিন্তু আবারও দুঃসংবাদ। মঙ্গলবারই আইসিএমআরের ডিজি বলরাম ভার্গব ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ জানিয়েছেন, বাইরে থেকে ফেরা ৪ আক্রান্তের শরীরে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন মিলেছে, ব্রাজিলের স্ট্রেন পাওয়া গিয়েছে একজনের শরীরে। এই দুই ভ্যারিয়েন্টের জন্য ওই দুই দেশে শুধু সংক্রমণ বেড়েছে, তা নয়। তৈরি হয়ে যাওয়া ভ্যাকসিনকেও ফাঁকি দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন। আর যে মিউটেশন দুশ্চিন্তার মূলে, সেই ই৪৮৪কে রয়েছে ব্রাজিলের স্ট্রেনেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভয় ঠিক এখানেই।
করোনা আরএনএ ভাইরাস। তার মিউটেশন হবে, নতুন স্ট্রেনের উদয় হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখতে হবে, নতুন স্ট্রেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল কি না। ভ্যাকসিনকে বোকা বানাচ্ছে কি না। এখনও পর্যন্ত সুখবর, প্রথম ৩ ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্নের’ কোনওটিতেই মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার নজির পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন। তাকে বাগে আনতে হিমশিম খাচ্ছে ভ্যাকসিনও। পরিস্থিতি এমনই, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়ার কাজ শুরুই করেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। সপ্তাহ খানেক আগে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে কোভিশিল্ডের ১০ লক্ষ ডোজ পাঠিয়েছিল ভারত। সেই টিকা এখনও ঠান্ডাঘরে বন্দি! শোনা যাচ্ছে, কোভিশিল্ডের সেই ডোজ় ফিরিয়ে দিতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৩৫১ বা ৫০১.ভি২। এতে যে ২১টি মিউটেশন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হচ্ছে ই৪৮৪কে মিউটেশনকে। যাতে ৪৮৪ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিড পজিশনে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। নেগেটিভ আয়নের গ্লুটামিক অ্যাসিডের পরিবর্তে এসেছে পজিটিভ আয়নের লাইসিন। এর ফলে মানবশরীরের রিসেপ্টর এসিই টু-র সঙ্গে জোট বাঁধার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। সেই কারণে হয়ে উঠছে আগের চেয়ে বেশি সংক্রামকও। সেই সঙ্গে বাড়ছে টিকায় তৈরি অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা।
এখনও পর্যন্ত রিপোর্ট, নতুন বিলিতি স্ট্রেনের উপর ভ্যাকসিনের কাজ করার ক্ষমতায় বিশেষ হেরফের হচ্ছে না। যেটা হচ্ছে আফ্রিকার স্ট্রেনের উপর। ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো! যেমন ব্রিটেনের ট্রায়ালে নোভাভ্যাক্সের এফিকেসি রেট অর্থাত্ কার্যকারিতার হার ৮৯.৩%। দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্র ৬০%। দেখা যাচ্ছে, টিকা দেওয়ার পর যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৯০% ক্ষেত্রেই দায়ী নতুন স্ট্রেন। আবার আমেরিকায় জনসন অ্যান্ড জনসনের কার্যকারিতার হার ৭২%। দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫৭%। সবচেয়ে খারাপ ফল অ্যাস্ট্রাজেনেকার। ব্রিটেন, ব্রাজিল মিলিয়ে টিকার কার্যকারিতার হার ছিল ৭০.৪%। দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্র ১০%। এই রিপোর্ট আসার পরই কোভিশিল্ড না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ঘটনা হল, ভারতে দু’টি ভ্যাকসিন অনুমোদন পেলেও সিংহভাগ টিকা দেওয়া হচ্ছে কোভিশিল্ডই। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হৃদকম্প বাড়ার কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন এ দেশে বেশি ছড়িয়ে পড়লে সত্যিই বড় বিপদ।
বিষয়টি মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব মন্তব্য করেছেন, ব্রিটেনের মতো এক্ষেত্রেও বিমানযাত্রীদের উপর নজরদারি করা হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিলের সঙ্গে সরাসরি বিমান যোগাযোগ নেই ভারতে। মূলত পশ্চিম এশিয়া হয়েই যাতায়াত করেন বিমানযাত্রীরা। তাই এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কী হবে, তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় বিমান পরিবহণ মন্ত্রক।
দক্ষিণ আফ্রিকার রিপোর্ট পাওয়ার পরই নতুন করে গবেষণা শুরু করেছে অক্সফোর্ড, অ্যাস্ট্রাজেনেকা। টিকায় কিছু পরিবর্তন এনে অস্ত্রে ধার ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। যা নিয়ে রাজ্যের প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেনে বিশেষ করে স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনে এমন ২-৩টি মিউটেশন হয়েছে, যার জন্য নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিকে এড়িয়ে যেতে পারছে। একে আমরা বলি ইমিউন এসকেপ মেকানিজম। হয়ত সবার ক্ষেত্রে হবে না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হওয়ার ফলে এফিকেসি রেট কমে যাবে।” করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই ভাইরাসের জিনের উপর নজরদারি চালাচ্ছে কল্যাণীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স। তার ডিরেক্টর সৌমিত্র দাস অবশ্য বলছেন, ”এখনও পর্যন্ত ভয়ানক দুশ্চিন্তার কোনও মিউটেশন ভারতে পাওয়া যায়নি, যাকে ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন বলা যেতে পারে। শুধু ই৪৮৪কে মিউটেশন থাকলেই চলবে না, তার দোসর মিউটেশনও চাই। তবেই ভ্যাকসিনকে এড়াতে পারবে। তেমন ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত আমরা পাইনি।’ পুরোপুরি উত্তর পেতে ইতিমধ্যেই ব্রাজিলের স্ট্রেন থেকে এমআরএনএ পৃথকীকরণের কাজ করে ফেলেছে এনআইভি পুনে। চলছে দক্ষিণ আফ্রিকা স্ট্রেন আইসোলেট করার কাজও। এরপরই শুরু হবে গবেষণা।
আরও পড়ুন: ‘অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা’র জন্য কেন্দ্রকে ধন্যবাদ, অপসারণে ‘ঠান্ডা’ প্রতিক্রিয়া কিরণের
তবে আমজনতাকে বেশি চিন্তিত হতে নিষেধ করে বিশেষজ্ঞদের সহজ দাওয়াই, মাস্ক পরুন। যতটা সম্ভব শারীরিক দূরত্ব মেনে চলুন। নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যেস চালিয়ে যান। তাহলে যে কোনও স্ট্রেনই শরীরে ঢোকার পথে ঠোক্কর যাবে। বাঁচার চাবিকাঠি কিন্তু যার যার হাতেই!