আজ আরজি কর-কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টে স্বতঃপ্রণোদিত মামলার দ্বিতীয় শুনানি। সিল বন্ধ খামে আরজি কর কাণ্ডের তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দিয়েছে সিবিআই। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে আরজি কর মামলার শুনানি চলছে।
সিবিআই স্টেটাস রিপোর্ট পেশ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট তা খতিয়ে দেখবে। ভাঙচুরের বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। তদন্ত চলবে। কলকাতা পুলিশ ভাঙচুরের ঘটনার তদন্ত করবে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে নির্দেশ, NTF এর বিশেষ পোর্টাল খোলা হোক, সেখানে সকলে মতামত জানাতে পারবেন। স্বাস্থ্য সচিবকে দেওয়া হল এই নির্দেশ।
কর্মবিরতির জন্য এবং প্রতিবাদ করার জন্য কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট পদক্ষেপ করেছে, এবার আশা করা হচ্ছে যে চিকিৎসকরা কাজে ফিরবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, যতক্ষণ না NTF এর রিপোর্ট আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে কাজে ফিরুন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে যাতে কোন রকম ঘটনা না ঘটে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়ে রাজ্য সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিচারপতি পারদিওয়ালা আইনজীবী কপিল সিব্বলের কাছে জানতে চান, আপনার টাইমলাইন অনুযায়ী ময়নাতদন্ত কখন হয়েছে? আইনজীবী সিব্বল জানান, সন্ধ্যা ৬.১০ মিনিট থেকে ৭.১০ মিনিট। বিচারপতি তখন জানতে চান, সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত হয়ে যাওয়ার পর কীভাবে একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা রুজু হল? আর যদি একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা না-ই হয়ে থাকে, তাহলে ময়নাতদন্তের কী প্রয়োজন ছিল? বিচারপতি তখন বলেন, যখন আপনি ময়নাতদন্ত করছেন, তার মানে এটি একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা। যখন সন্ধ্যা ৬টা১০ মিনিট থেকে ৭টা ১০ মিনিটের মধ্যে ময়নাতদন্ত করা হয়ে যায়, তাহলে রাত সাড়ে ১১টার সময়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা রুজু করার কী প্রয়োজন ছিল?
আইনজীবী সিব্বল উত্তর দেন, না, এটা এফআইআর, কেবল UD কেস নয়।
বিচারপতি পারদিওয়ালা তখন আইনজীবী সিব্বলের কাছে জানতে চান, যে রেকর্ড হাতে এসেছে, তাতে ৯ অগস্ট টালা থানায় UD কেস ৮৬১ দায়ের হয়। সেটি দায়ের হয় রাত সাড়ে এগারোটায়। এফআইআর দায়ের হয় রাত ১১.৪৫ মিনিটে। এটা কি সঠিক?
আইনজীবী সিব্বল বলেন, আমাদের কাছে গোটা টাইমলাইন রয়েছে। UD কেস দায়ের হয় দুপুর ১.৪৫ মিনিটে।
সলিসেটর জেনারেল তখন বলেন, না এই তথ্য একেবারেই ঠিক নয়। বিচারপতি তখন পুলিশের কোনও আধিকারিক আদালতে উপস্থিত রয়েছেন কিনা তা জানতে চান, তার কাছ থেকে ব্যাখ্যা চান।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা বিষয় অত্য়ন্ত বিস্ময়ের। অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে সকাল ১০.১০ মিনিটে। পুলিশ প্রথমে একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে। কিন্তু প্রশ্ন ময়নাতদন্ত হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ কীভাবে একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা রুজু করল? রাজ্যের তরফে আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, আমার কাছে গোটা ঘটনার একটা টাইমলাইন রয়েছে। সলিসেটর জেনারেল তখন তাঁর কাছে টাইমলাইন চান।
প্রধান বিচারপতি সিবিআই-এর দেওয়া স্ট্যাটাস রিপোর্ট খতিয়ে দেখেন। রাজ্যের তরফেও এদিন একটি রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, রাজ্যকে কোনও স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা করতে বলা হয়নি, কলকাতা পুলিশকে বলা হয়েছিল রিপোর্ট করতে। রিপোর্ট দেখে প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করেন, অভিযুক্তের মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট কোথায়? সলিসেটর জেনারেল বলেন, আমরা এটার সঙ্গে অভিযুক্তের মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট দিইনি। রাজ্যের তরফে কপিল সিব্বল সওয়াল করেন, এটা গোটাটাই কেস ডায়েরির পার্ট, আর সেটা জমা দেওয়া হয়েছে। সলিসেটর জেনারেল জানান, দেহ দাহ করার পর রাত ১১.৪৫ মিনিটে প্রথম এফআইআর দায়ের করা হয়। পরিবারকে জানানো হয়েছিল এটা আত্মহত্যার ঘটনা। চিকিৎসকদের চাপে পড়ে ময়নাতদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি করানো হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতি এরপর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখতে চান। সলিসেটর জেনারেল সেটা জমা দেন, তিনি জানান, সেটি পুলিশের কাছ থেকে পেয়েছেন। রাজ্যের তরফে আইনজীবী সিব্বল বলেন, আমাদের কাছে এই গোটা ঘটনার টাইমলাইন রয়েছে, কটায় কখন কোন ঘটনা ঘটেছে।
দ্বিতীয় দিনের শুনানিতেও উঠে এল আরজি করে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গও। আইনজীবী নন্দী সওয়াল করেন, আমরা পাঁচ চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দলকে সামনে এনেছি। যাঁরা সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু তথ্য দেবেন। পাশাপাশি এই খুন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গেও কিছু তথ্য দেবেন। এর পিছনে একটা প্রাতিষ্ঠানিক সমঝোতা রয়েছে। এই সন্দীপ ঘোষই হাসপাতালে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর ভাড়া বাবদ ১৪ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন। আমি এই বিষয়টি রাজ্য সরকারের গঠিত সিটেরও ভূমিকার বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কারণ সিট এই একই ব্যক্তি সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক দুর্নীতি অভিযোগের তদন্ত করেছিল।
সিনিয়র আইনজীবী গীতা লুথরা সওয়াল করেন, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত। তাঁদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে। তদন্তকারীদের কাছে সিল বন্ধ খামে তাঁরা কয়েকজনের নাম দিয়েছেন বলে তাঁরা দাবি করেছেন। আর তারপর থেকেই তাঁদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করেন, “কারা ভয় দেখাচ্ছেন? কাদের দ্বারা ভীত?”
আইনজীবী জানান, যাঁরা ঘটনার প্রতিবাদে মুখ খুলেছিলেন, তাঁদেরকেই টার্গেট করা হচ্ছে, তাঁদের কাছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিডিয়োর টাইমলাইন রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি আবারও প্রশ্ন করেন, কারা ভয় দেখাচ্ছেন?
আইনজীবী জানান, কর্মকর্তাদের দ্বারাই। আমি কলকাতার চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছিলাম। দুষ্কৃতীদের তরফেও চাপ আসছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের একাংশের তরফেও চাপ আসছে। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি দেখে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, দয়া করে চিকিৎসকদের আশ্বস্ত করুন, আমরা তাঁদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমার পরিবারের কোনও এক সদস্য যখন অসুস্থ ছিলেন, আমি হাসপাতালের মেঝেতে শুয়েছিলাম। তখন চিকিৎসকদের অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিলাম। আমি দেখেছিলাম, কীভাবে কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হয় জুনিয়র চিকিৎসকদের। আমি দেখেছিলাম প্রত্যেক ডাক্তার ৩৬ ঘণ্টার ওপর কাজ করেন।
এক আইনজীবী এদিন সওয়াল করেন, জুনিয়র চিকিৎসকরা হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন। সেটা ৩৬ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টাও ছাড়িয়ে যায়। কীভাবে এক জন চিকিৎসক ৩৬ ঘণ্টা টানা ডিউটি করতে পারেন। যিনি করছেন তাঁর কোনও কোনও শারীরিক ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। যৌন নিগ্রহ তো অনেক দূরের কথা, সামান্য নিগ্রহই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আর তাঁর শরীরে থাকে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার এই বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এটা লক্ষ্য করা গিয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে জুনিয়র চিকিৎসকরা বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সেটা কেবল যৌন হয়রানিই নয়। আর এটা অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। আমরা অনেক ইমেল পেয়েছি। জুনিয়র চিকিৎসকদের ৪৮ ঘণ্টা, ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়।