জোশীমঠে বিপর্যয়ের নেপথ্যে কার হাত? উঠে আসছে ‘নানা মুনির নানা মত’

গতকাল উত্তরাখণ্ডে হিমবাহ ভেঙে যে হড়পা বান আসে, তাতে ভেসে যায় অলকানন্দা নদীর পাশে অবস্থিত বহু বাড়ি। একদিন কেটে গেলেও এখনও নিখোঁজ প্রায় ২০০ জন।

জোশীমঠে বিপর্যয়ের নেপথ্যে কার হাত? উঠে আসছে 'নানা মুনির নানা মত'
বিপর্যয়ের মুহূর্ত।
Follow Us:
| Updated on: Feb 08, 2021 | 6:19 PM

জোশীমঠ: নন্দাদেবী হিমবাহের একাংশ ভেঙে পড়ায় যে ধ্বংসলীলার সাক্ষী থাকল জোশীমঠ (Joshimath), তার আন্দাজ কি আগেই করেছিল গ্রামবাসীরা? বিপর্যয়ের পরই এমনই প্রশ্ন নিয়ে বাঁধছে রহস্য। বিপর্যয়ের একদিন কেটে গেলেও এখনও চলছে উদ্ধারকার্য। এত তাড়াতাড়ি বিপর্যয়ের কারণ জানাও সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বেশ কয়েকটি যুক্তি উঠে এসেছে বিভিন্ন মহলের বক্তব্য থেকে।

একদিকে, বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী যেমন দাবি করেছেন যে তিনি আগেই বিষয়টি আন্দাজ করেই ঋষিগঙ্গা হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট গঠনে সম্মতি দেননি। অন্যদিকে, গ্রামবাসীরাও আঙুল তুলছে প্রশাসনের গাফিলতির দিকেই। তবে বিশ্বায়নের কারণে হিমবাহের গলন বা ২০১৩ সালে কেদারনাথে মেঘভাঙা বৃষ্টির কারণে যে বন্যা হয়েছিল, সেই বিষয়গুলিও বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।

হিমবাহের একাংশ ভেঙে পড়া-

হিমবাহের একাংশ ভেঙে পড়ার কারণে গতকাল উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠে যে হড়পা বান এসেছিল, তার ক্ষয়ক্ষতি বা কারণ এখনই আন্দাজ করা সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফে জানানো হয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে ঋষিগঙ্গা ও ধৌলিগঙ্গার উপরে হিমবাহের গলনের কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে বলে আন্দাজ। সাধারণত হিমবাহের একটি বড় অংশ ভেঙে নদীতে পড়লে সেখানে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এটিকে এককথায় “হিমবাহের হ্রদ উপচে পড়ে বন্যা” বা “গ্লেসিয়াল লেক আউটবাস্ট ফ্লাড” বলা হয়।

মেঘ ভাঙা বৃষ্টি-

অন্যদিকে ইনদওরে আইআইটির অধ্যাপক জানিয়েছেন, হিমবাহ ভেঙে নয়, বরং মেঘভাঙা বৃষ্টির কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে। তিনি বলেন, “গুগলের উপগ্রহ চিত্রে কোনও তাল বা হ্রদের ছবি দেখা যায়নি। তবে ওই অঞ্চলে হিমবাহের নীচে কোনও হ্রদ থাকতে পারে। আচমকাই হিমবাহের গলনে বা বরফের স্তরে ভাঙন দেখা দেওয়ায় হ্রদের জলস্তরে চাপ পড়ে। এবং সেখান থেকেই বাঁধ ভাঙা প্লাবনের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিকেই প্রধান কারণ হিসাবে ধরা হচ্ছে।”

আরও পড়ুন: Uttarakhand Joshimath Dam Disaster Live: খুলল সুড়ঙ্গের মুখ, হেলিকপ্টারে ত্রাণ পৌঁছচ্ছে আইটিবিপি

উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা-

গতকাল যে বিপর্যয় ঘটে উত্তরাখণ্ডে, তার আন্দাজ আগেই করেছিলেন চামোলির রেনি গ্রামের বাসিন্দারা। সেই প্রেক্ষিতেই ২০১৯ সালে এক গ্রামবাসী উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে ঋষিগঙ্গা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। আর্জিতে তিনি আবেদনকারী জানিয়েছিলেন, এই বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হলে পরিবেশগত বিভিন্ন পরিবর্তন আসবে, যারফলে একদিকে নদীর পাশে বসবাসকারীদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে, তেমনই ওই অঞ্চলের বন্যপ্রাণে আঘাত নেমে আসার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে চিপকো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই রেনি গ্রাম। সেই সময় গ্রামের মহিলারা লাগাতার গাছ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফলে গাছ কাটা সম্ভব হয়নি। ২০১৯ সালের জনস্বার্থ মামলাতেও রেনি গ্রামের বাসিন্দাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের তরফে পিটিশন দাখিল হওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে জবাব দেওয়ার নোটিস জারি করা হলেও শেষ অবধি কোনও লাভই হয়নি। ২০০৫ সালে চামোলি অঞ্চলেই গড়ে ওঠে ঋষিগঙ্গা হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট।

বিপর্যয়ে ঋষিগঙ্গা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভূমিকা-

সাধারণ বাসিন্দাদের আপত্তি সত্ত্বেও গড়ে ওঠা ঋষিগঙ্গা বিদ্যুৎ প্রকল্পে অলকানন্দা নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে নদীপথ সরু হয়ে যায়। এদিকে গতকাল নন্দাদেবী হিমবাহের একাংশ ভেঙে পড়ায় হড়পা বান আসে নদীতে। মাঝপথে অবস্থিত ঋষিগঙ্গা বিদ্যুৎ প্রকল্পে ধাক্কা খেয়ে সেই জলোচ্ছ্বাস বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভাঙা অংশগুলি সমেতই হুড়মুড়িয়ে নীচের দিকের নামতে থাকে। সেখানে তপোবন ও পিপল কোটি নামক দুটি সরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বেসরকারি বিষ্ণুপ্রয়াগ প্রকল্পেও ধাক্কা মারে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কাজ করা শ্রমিকরাও জলের তোড়ে ভেসে যান। এখনও অবধি নদী থেকে ১৪টি দেহ উদ্ধার করা হলেও নিখোঁজ ১৭০ জনেরও বেশি।

বিশ্বায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-

শীতের শেষে আচমকাই হিমবাহে ভাঙনের কারণ হিসাবে অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বায়নকে দায়ী করেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই হিমালয়ের তাপমাত্রা বাড়ছে এবং সেই কারণে জমে থাকা বরফে গলন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। হিমবাহের ভাঙন হিসাবেও সেই গ্লোবাল ওয়ার্মিংকেই দায়ী করা হচ্ছে। ডিআরডিও-র তরফে জানানো হয়, আকাশপথে পরিদর্শন করে প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে মূল হিমবাহ থেকেই তৈরি হওয়া বরফের একটি বড় অংশ ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। সেটিই ভেঙে পড়ে। উপত্যকায় এটি একটি হ্রদের আকার নেয় এবং পরবর্তী সময়ে সেখান থেকেই জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়।

ইতিমধ্যেই ঘটনার পর্যালোচনায় উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিবেন্দ্র সিং রাওয়াত একটি রিভিউ বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠক শেষে উদ্ধারকার্যে সাহায্যের জন্য রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল থেকে ২০ কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান! মাথায় কালি ঢেলে, শাড়ি পরিয়ে ঘোরাল বিজেপি নেতাকে