বিশ্লেষণ: ইতিহাস ফেরাচ্ছেন মমতা, সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে কতটা যুক্তিযুক্ত বিধান পরিষদ?

সুমন মহাপাত্র |

Jun 28, 2021 | 9:33 PM

খাস বাংলায়ও বিধান পরিষদ ছিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বিধান পরিষদ ছিল পশ্চিমবঙ্গে। তারপর বাংলা কংগ্রেস ও যুক্তফ্রন্ট সরকার তা বাতিল করে দেয়।

বিশ্লেষণ: ইতিহাস ফেরাচ্ছেন মমতা, সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে কতটা যুক্তিযুক্ত বিধান পরিষদ?
গ্রাফিক্স- অভীক দেবনাথ

Follow Us

কলকাতা: রাজ্যে বিপুল ভোটে জয় পেয়ে সরকার গড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। টানা তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, ভোটে জিতলে এ বার বিধান পরিষদ তৈরি হবে। সেই মতো রাজ্যে শুরু হয়েছে বিধান পরিষদ তৈরির কাজও। মন্ত্রিসভায় পাশও হয়ে গিয়েছে বিধান পরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাব। এ বার বিধানসভায় যাবে এই প্রস্তাব। তা বিধানসভায় পাশ হওয়ার পর রাজ্যপাল অনুমোদন দিলেই রাজ্যে গঠন প্রক্রিয়া এগোবে বিধান পরিষদের। সংসদ হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরই সম্ভব রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালেও জয়ী হওয়ার পর বিধান পরিষদ গড়ার কথা জানিয়েছিলেন মমতা।

বিধান পরিষদ কী?

ভারতে সংসদের দু’টি কক্ষ। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা ও নিম্নকক্ষ হল লোকসভা। অর্থবিল ছাড়া যে কোনও বিল সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়ার পরই আইনে পরিণত হয়। বিধান পরিষদও তেমনই। রাজ্যের আইনসভার দু’টি কক্ষ সম্ভব। যার উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদ ও নিম্নকক্ষ বিধানসভা। রাজ্য সরকার চাইলে এই বিধান পরিষদ সচল করতে পারে। আবার রাজ্য সরকার এই বিধান পরিষদের অবলুপ্তিও ঘটাতে পারে। রাজ্যের আইনসভার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম, অর্থবিল ছাড়া রাজ্যের যে কোনও বিল দুই কক্ষেই পাশ করাতে হয়।

বিধান পরিষদের সদস্য সংখ্যা: সংবিধান অনুযায়ী, বিধায়ক সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ সংখ্যক সদস্য বিধান পরিষদে থাকতে পারেন। তবে সর্বনিম্ন ৪০ জনের কম হলেও হবে না। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদে সর্বনিম্ন ৪০ জন ও সর্বোচ্চ ৯১ জন থাকতে পারবেন। বিধান পরিষদে সদস্যদের মেয়াদ হয় ৬ বছর। প্রতি দু’বছর অন্তর অবসর নিতে হয় এক তৃতীয়াংশ সদস্যকে।

বিধান পরিষদে কীভাবে নির্বাচিত হন সদস্যরা?

বিধান পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন বিধায়ক, পঞ্চায়েত, পুরসভা, পুরনিগমের প্রতিনিধি, স্নাতক ও শিক্ষকদের ভোটে। এক তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচন করেন বিধায়করা, এক তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচন করেন পুরসভা, পুরনিগমের প্রতিনিধিরা, এক ষষ্ঠাংশ সদস্য নির্বাচিত হন স্নাতকদের মাধ্যমে, এক ষষ্ঠাংশ সদস্য নির্বাচিত হন শিক্ষকদের মাধ্যমে।

দেশের কোন কোন রাজ্যে বিধান পরিষদ রয়েছে?

দেশের মোট ৬ রাজ্যে বিধান পরিষদ রয়েছে। অন্ধ্র প্রদেশের বিধান পরিষদে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ৫০, মনোনীত ৮ সদস্য। মোট বিধান পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫৮। বিহারের বিধান পরিষদে ৭৫ জন সদস্য রয়েছেন যার মধ্যে ৬২ জন নির্বাচিত ও ১২ জন মনোনীত। কর্নাটকে বিধান পরিষদে ৭৫ জন সদস্য রয়েছেন। যার মধ্যে ৬৪ জন নির্বাচিত ও ১১ জন মনোনীত। মহারাষ্ট্রের বিধান পরিষদে ৭৮ জন সদস্য আছেন। যার মধ্যে ৬৬ জন নির্বাচিত এবং ১২ জন মনোনীত। তেলেঙ্গনা বিধান পরিষদে ৪০ জন সদস্য রয়েছেন। যার মধ্যে ৩৪ জন নির্বাচিত ও ৬ জন মনোনীত। উত্তর প্রদেশেও ১০০ জন বিধান পরিষদের সদস্য রয়েছেন। যার মধ্যে ৯০ জন নির্বাচিত ও ১০ জন মনোনীত। উল্লেখ্য বিধান পরিষদের সদস্য হলেও মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। এ ভাবেই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নীতীশ কুমার।

এর আগে বিধান পরিষদ ছিল অসম, জম্মু ও কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও মধ্য প্রদেশেও। খাস বাংলায়ও বিধান পরিষদ ছিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বিধান পরিষদ ছিল পশ্চিমবঙ্গে। তারপর বাংলা কংগ্রেস ও যুক্তফ্রন্ট সরকার তা বাতিল করে দেয়।

রাজনৈতিক তরজা: বিধান পরিষদ কি আদৌ প্রয়োজনীয়? এ নিয়ে সুবিশাল রাজনৈতিক তরজা রয়েছে। কেউ মনে করেন বিধান পরিষদ অপ্রয়োজনীয়। শুধুমাত্র টাকার অপচয় আবার কেউ মনে করেন, সংসদের মতো আইনসভারও দু’টি কক্ষ থাকা উচিত। এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে হাঁটার জন্য অপ্রয়োজনীয় বিধান পরিষদ বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পিছন দিকে হাঁটছে। যা বাতিল হয়ে গিয়েছে, তাকে আবার চালু করছে। তিনি বলেন, “এটা অর্থের অপচয়, পরিকল্পনার অপচয়। কিছু বাতিল হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক নেতাকে বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা দেওয়ার মতো। বিধান পরিষদের সঙ্গে রাজ্যসভার কোনও মিল নেই।” রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, “বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকে জায়গা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এটা হল স্রেফ সাদা হাতি পোষা। বিধান পরিষদের সদস্যদের কোনও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই।”

বিধান পরিষদের তথ্য

তৃণমূল: এ বিষয়ে তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় জানান, সংবিধান প্রণেতারা আইনসভার দু’টি কক্ষের কথাই বলেছিলেন। এটা মূলত ব্রিটিশ পরিকাঠামোয়। তিনি বলেন, “আজকের দিনে অনেকে এটাকে বিলাসিতা ভাবতে পারেন। কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিল একটি কক্ষে পাশ হয়ে অন্য কক্ষে আটকে যেতে পারে, তাই কাজে গতি আনতে অনেকে সংশয় প্রকাশ করে বলেন একটা কক্ষ থাকলেই হবে। কিন্তু এই বক্তব্যও আছে অনেকেই বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়াতে চান না বা জয়ী হয়ে আসতে পারেন না।” তাঁর মতে, বিধান পরিষদে যাঁরা আসেন, তাঁরা নির্বাচিত হয়েই সাংবিধানিক পদ্ধতিতেই আসেন। এর আগে ১৯৬৯ সালে বিধান পরিষদ বাতিলের বিষয়ে তিনি জানান, তখন কোনও দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিল না, তাই তারা বিধান পরিষদ তুলে দিয়েছিল। বিধান পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিতই হন। শিক্ষক, স্নাতক-সহ একাধিক ভোট প্রক্রিয়ায় তাঁরা নির্বাচিত হন।

সুখেন্দু শেখর রায়ের মন্তব্য

সিপিএম: সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ বিষয়ে জানান, এই বিপদের সময়ে মানুষকে ওষুধ, অক্সিজেন, খাদ্য ঠিকমতো দিতে পারছে না সরকার। হাসপাতালে বেড ও পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করতে পারছে না। অথচ শাসক দলের কয়েকজনকে পিছনের দরজা দিয়ে পুর্নবাসন দিতে বিধান পরিষদের নামে সাদা হাতি পোষার ব্যবস্থা করতে চাইছে। এর জন্য যে বিপুল খরচ হবে, তা জনগণের উপর চাপবে। প্রধানমন্ত্রীর পথে না হেঁটে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করে রাজ্য সরকারের উচিত এখনই সঙ্কটে থাকা রাজ্যবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। রোজগারে সাহায্য করা। মহামারীর বিপদের সময়ে অর্থনীতিতে আরও বোঝা চাপানোর কাজ আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। ভারতে জাতীয় স্তরে আইনসভার উচ্চকক্ষ বা রাজ্যসভা থাকা উচিত। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে এটা থাকা দরকার। কিন্তু রাজ্যস্তরে কী হবে, সেটা আমাদের দেশের পরিস্থিতি আর রাজ্যের প্রেক্ষিতে ভাবতে হবে। বিধানসভায় যে দল সংখ্যা গরিষ্ঠ তারাই যদি বিধান পরিষদে গরিষ্ঠ হয়, তবে তো বিধান পরিষদ সরকারের কোনও কাজে এমনকি, ন্যায্য যুক্তিতেও বাধা দিতে পারবে না। একই মত সিপিএমের তরুণ মুখ দীপ্সিতা, সৃজনেরও।

সিপিএমের মন্তব্য

বিজেপি: মমতার বিধান পরিষদ নিয়ে আপাতত চুপ বিজেপি। পদ্ম নেতা রাহুল সিনহা জানান, আপাতত এ নিয়ে দলের কোনও স্ট্যান্ড তৈরি হয়নি। ভবিষ্যতে দলের স্ট্যান্ড তৈরি হলে তা জানানো হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যেহেতু বিজেপি শাসিত বিহারে বিধান পরিষদ আছে, তাই চড়া সুরে বিরোধিতা করতে পারছে না বিজেপি।

আরও পড়ুন: করোনা চেন ভাঙতে পারবে লকডাউন, কী হতে চলেছে বাংলার?

Next Article