নয়া দিল্লি: সোমবার (৭ নভেম্বর) এক ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তি এবং সরকারি চাকরিতে অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর অংশ বা ইডব্লুএস(EWS)-এর জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের বিষয়ে সংবিধান সংশোধন বহাল রেখেছে। এর আগে যারা সংরক্ষণ ছিল শুধুমাত্র সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য। ফলে রাজপুত বা পণ্ডিতদের মতো তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন,তাদের জন্য কোনও সংরক্ষণের সুবিধা ছিল না। এদিনের রায়ে তার বদল ঘটল। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই নতুন সংরক্ষণ সম্পর্কে –
তিনজন পক্ষে, দুইজন বিপক্ষে
এদিন শীর্ষ আদালত অবশ্য এই বিষয়ে ঐক্যমত হতে পারেনি। ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের তিন বিচারপতি – দীনেশ মহেশ্বরী, বেলা ত্রিবেদী এবং জেবি পর্দিওয়ালা সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি ইউইউ ললিত এবং বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাট এর বিপক্ষে মত দেন।
ইডব্লুএস কোটা কী?
এতদিন তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য়ই শিক্ষা, চাকরি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ছিল। সেই সংরক্ষণের ভিত্তি ছিল শুধুমাত্র জাতি পরিচয়। অনেক ক্ষেত্রেই জাতি পরিচয়ে উচ্চবর্ণের হওয়ায় সংরক্ষণের সুবিধা পেতেন না আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ। কাজেই এসসি, এসটি এবং ওবিসি-র বাইরে যারা আছে, তাদেরকেও সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়ার জন্য ক্রমে সরকারের উপর চাপ বাড়ছিল। এরপর, ২০১৯ সালে মোদী সরকার সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনী এনে আর্থিকভাবে অনগ্রসর বা ইডব্লুএস কোটা তৈরি করেছিল মোদী সরকার। তাদের জন্য ভর্তি ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। তবে, এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছিল।
ইডব্লুএস কোটা পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্তাবলী কী কী?
– মোট পারিবারিক বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকা বা তার নিচে
– ৫ একরের বেশি কৃষি জমি থাকা যাবে না
– জমি ছাড়া বাড়ির পরিমাপ হতে হবে ১০০০ বর্গফুটের কম
– পুর এলাকায় জমি হলে, তার মাপ হতে হবে ১০০ গজের কম
– পুর এলাকার বাইরে জমি হলে, তার মাপ হতে হবে ২০০ গজের কম
– এসসি, এসটি এবং ওবিসিরা এই সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন না
ইডব্লুএস কোটা নিয়ে বিতর্ক কীসের? কেন এই সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল?
দেশের কোনও রাজনৈতিক দলই ইডব্লুএস কোটার বিরোধিতা করেনি। কিন্তু বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং আইনজ্ঞরা এই সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে প্রায় ৪০টি আবেদনের শুনানি হয়েছে। আবেদনকারীরা সংশোধনীটিকে “সামাজিক ন্যায়বিচারের সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর আক্রমণ” এবং “সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা” বলে দাবি করেছিলেন। তাদের মতে, সংবিধানের ৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির কথা বলা হয়নি। এই নীতি প্রয়োগ করা হলে, সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমতা বজায় থাকবে না। এই নীতি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করে। শুধু তাই নয়, এটি মন্ডল কমিশন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেছিল, নয়া সংরক্ষণ নীতির ফলে তাও লঙ্ঘিত হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সামনে ছিল তিনটি প্রশ্ন
এদিনের রায় দেওয়ার সময় সাংবিধানিক বেঞ্চ মূলত তিনটি প্রশ্ন বিবেচনা করেছে –
১. ১০৩তম সংবিধান সংশোধনী কি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন করে?
২. ইডব্লুএস কোটার মাধ্যমে অনুদানহীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র যে বিশেষ বিধান করার অনুমতি পাচ্ছে, তা কি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করে?
৩.ইডব্লুএস কোটার সুযোগ থেকে এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের বাদ দেওয়া কি সাংবিধানিক?
ঐক্যমত হননি বিচারপতিরা
প্রথম দুটি প্রশ্নের ক্ষেত্রে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনী বহাল রাখার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। কিন্তু, তৃতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাট জানান, সংশোধনীটি খারিজ করা উচিত। তাঁর পক্ষেই মত দেন প্রধান বিচারপতি ইউইউ ললিতও। তবে বাকি তিন বিচারপতি তৃতীয় প্রশ্নেও সংশোধনীটিকে বহাল রাখার পক্ষে মত দেওয়ায়, তাদের আপত্তি রায়ে প্রতিফলিত হয়নি। শীর্ষ আদালতের খণ্ডিত রায়ে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ বহাল থাকল।