বিজয় ত্রিবেদী: সামনেই পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনের আগে স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু হবে, একথা সকলেরই জানা। ভোটে জিততে সকলেই হিন্দুদের মন জিতে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই প্রক্রিয়াও ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। কংগ্রসে নেতা রাহুল গান্ধী নিজেকে ‘আসল হিন্দু’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। রাহুলের অভিযোগ বিজেপি, ‘হিন্দুত্ববাদী’ যাঁরা ভুয়ো হিন্দু ধর্মের প্রচার করেন। এই পরিস্থিতিতে তাই আরও একবার মনে করা প্রয়োজন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন অটল বিহারী বাজপেয়ী ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কী ভাবতেন।
বাজপেয়ী নিজে শুধু সনাতনী হিন্দু ছিলেন না, তার পাশাপাশি সনাতন হিন্দু ধর্মের অন্তর্নিহিত নির্যাস তিনি বুঝতেন। হিন্দু ধর্ম নিয়ে এক এক প্রবন্ধে বাজপেয়ী লিখেছিলেন, “হিন্দুধর্মের প্রতি আমার আকর্ষণের প্রধান কারণ হল এটি মানবজাতির সর্বোচ্চ ধর্ম। হিন্দু ধর্ম কোন বইয়ের সাথে বা কোন নির্দিষ্ট ধর্ম প্রচারকের সাথে যুক্ত নয়। হিন্দু ধর্মের রূপটি সর্বদা হিন্দু সমাজ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং এই কারণেই এটি অনাদিকাল থেকে ক্রমবর্ধমান এবং বিকাশ লাভ করে আসছে।”
যখন সমগ্র সমাজ ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে সমাজে বিভাজন তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ই বাজপেয়ীর বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করা হয়। একবার তিনি বলেছিলেন, “আপনারা জানেন, আমার জীবনের প্রথম দিকে, আমি পৈতে পরিধান করতাম, কিন্তু যখন আমি নিজেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে নিবেদিত করি, তখন আমি এটি সরিয়ে দিয়েছিলাম কারণ আমি অনুভব করেছি যে এটি আমাকে অন্য হিন্দুদের থেকে আলাদা করেছে। আগে ‘শিখা’ এবং ‘সূত্র’ ছিল হিন্দুদের দুটি পরিচয়। বেশিরভাগ মানুষ শিখাকে আর রাখেন না। শিখা পালন না করে কেউ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছে এমন কথা বলা ভুল। হ্যাঁ, শিখা যখন জোর করে কাটা হয়, ধর্মীয় দমনের রূপক, তখন তা বন্ধ করা আমাদের কর্তব্য।”
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বাজপেয়ীর নিজের মতবাদ ছিল। তিনি পশ্চিমী ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা বিশ্বাসী ছিলেন না , কিন্তু পাশাপাশি গান্ধীজির ‘সর্ব ধর্ম সম্ভব’ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সর্ব ধর্ম সম্ভব’ আমাাদের জীবনের চলার পথ প্রদর্শন করেন। ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা অনেক বেশি ইতিবাচক বলেই মনে করতেন অটল বিহারী। অস্পৃশ্যতা নিয়েও বরাবরই সরব হয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। ১৯৬৮ সালে সংসদে এই সংক্রান্ত একটি আলোচনায় অংশগ্রহন করে তিনি জানিয়েছিলেন, আমরা মানতে প্রস্তুত নই যে অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের একটি অংশ। অস্পৃশ্যতা একটি পাপ এবং একটি অভিশাপ। অস্পৃশ্যতা একটি কলঙ্ক। এই কলঙ্ক দূর না হওয়া পর্যন্ত, আমরা মাথা উঁচু করে বিশ্বের মুখোমুখি হতে পারব না।
সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর। তিনি মনে করতেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের দেশের উন্নয়নের মূলস্রোতে রাখতে হবে। সেই সময় তিনি জনসংঘের সভাপতি ছিলেন। সভাপতি হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, জনসংঘ সমস্ত ভারতীয়কে এক হিসাবে বিবেচনা করে এবং চিরকালই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুতে বিভক্ত করার বিরোধী। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘুদের সিদ্ধান্ত হয় রাজনীতির ভিত্তিতে, ধর্ম, ভাষা বা বর্ণের ভিত্তিতে নয়। জনসংঘ জানিয়েছে যে তারা সব সংখ্যালঘুর সঙ্গে সমান আচরণ করতে সম্মত। তাদের বিরুদ্ধে যে কোনও বৈষম্য অন্যায় হলে জনসংঘ এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে।”
দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর, আদালতের রায়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি হয়েছে। রাম মন্দির নিয়ে অনেক চরাই উতরাইয়ের সাক্ষী আমাদের দেশ। রাম মন্দির ইস্যুতে বাজপেয়ীর স্পষ্ট মতামত ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “মুম্বইয়ের একটি জনসভা থেকে আমি বলেছিলাম, মুসলিমদের উচিৎ রাম জন্মভূমি হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া। তারা আশ্বস্ত হতে পারেন, হিন্দুরা পাশের ঐতিহাসিক নির্মাণটিকে ধ্বংস করবেন না। আসল নির্মাণের পাশে নতুন করে একটি মন্দির তৈরি হবে।” সেই সময়ে বাজপেয়ীর সেই পরামর্শকে কেউ আমল দেয়নি। পরবর্তী ঘটনা সকলের জানা।