২০১৩ সাল। ফোন বেজে উঠেছিল বাবা সিদ্দিকির। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন তুলছিলেন বাবা সিদ্দিকি। ফোনের ওই পাশে থাকা ব্যক্তির গলায় গনগনে রাগ। সে বলল, ‘রাম গোপাল ভার্মাসে কহকর তেরি ফিল্ম বনআউঁ ক্যা, এক থা এমএলএ (রাম গোপাল ভার্মাকে বলে তোরও একটা সিনেমা বানাবো নাকি, এক বিধায়ক ছিলেন)?’ এই ফোনকলের খবর গোটা দেশের খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল। ঘুম উড়ে গিয়েছিল মুম্বই পুলিশের। কারণ ফোনের ওপাশ থেকে যে ওই হুমকি দিয়েছিল, সে আর কেউ নয়, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন’ দাউদ ইব্রাহিম। তারপর, ১১ বছর পর কেটে গিয়েছে। গত শনিবার খুন হয়েছেন বাবা সিদ্দিকি। এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের গ্যাং। তারা বলেছে, সলমন খান এবং দাউদ ইব্রাহিমকে যারা সাহায্য করবে, তাদেরই এই পরিণতি হবে। কেন বাবা সিদ্দিকিকে হুমকি দিয়েছিল দাউদ? মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন এই মন্ত্রীর সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের কী সম্পর্ক ছিল? কেন বিষ্ণোই গ্যাং এই হত্যাকাণ্ড ঘটাল?
১২ অক্টোবর রাতে বাবা সিদ্দিকীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের তিন শ্যুটার। দুজন শ্যুটার উত্তর প্রদেশের, আরেকজন হরিয়ানার। ধরমরাজ কাশ্যপ, শিব কুমার ওরফে শিবা এবং গুরনেল সিং-কে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে মুম্বই পুলিশ। তবে, তার আগেই বিষ্ণোই গ্যাং সোশ্যাল মিডিয়ায় জানায়, “সলমন খান, আমরা এই যুদ্ধ চাইনি। কিন্তু আপনি আমাদের ভাইয়ের ক্ষতি করেছেন। আজ বাবা সিদ্দিকিকে খুব ভাল মানুষ বলা হচ্ছে। কিন্তু, তিনি এক সময় দাউদের সঙ্গে মকোকা আইনে অভিযুক্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ, অনুজ থাপন এবং দাউদকে বলিউড, রাজনীতি এবং সম্পত্তির লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত করা। কারও সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। তবে যারাই সলমন খান এবং দাউদ গ্যাং-কে সাহায্য করবে, তাদের বলছি আপনারা হিসেব কষে রাখুন। কেউ যদি আমাদের কোনও ভাইদের হত্যা করে, তবে আমরা অবশ্যই প্রতিক্রিয়া জানাই।”
লরেন্সের গ্যাংয়ের এই হুমকি ভিডিয়ো থেকে এটা পরিষ্কার, সলমন খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এবং অপরাধ জগতের সঙ্গে তাঁর সংযোগের কারণেই বাবা সিদ্দিকীকে নিশানা করেছিল লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং। ওয়াই ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পেতেন তিনি। তা সত্ত্বেও, বিষ্ণোই গ্যাংয়ের তিন শ্যুটার সহজেই বাবা সিদ্দিকীর উপর হামলা চালিয়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার ছয় মাস আগেই সলমন খানের বাড়িতে গুলি চালিয়েছিল বিষ্ণোই গ্যাং। অনেকের মতে, বাবা সিদ্দিকির হত্যা তাঁর আপন কর্মফল। অপরাধ জগতের সঙ্গে তাঁর কথিত সংযোগ এবং তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে তাঁর দিকে। আসলে দীর্ঘদিনের বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী হলেও, অনেকেরই দাবি, আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং বলিউডের মধ্যে সেতু ছিলেন দাউদ ইব্রাহিম।
১৯৯৮ সালে বিহারের রাজধানী পটনায় জন্মেছিলেন জিয়াউদ্দিন সিদ্দিকী, পরে তিনি বাবা সিদ্দিকি নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন। বাবা ছিলেন আব্দুল রহিম সিদ্দিকী এবং মা রাজিয়া সিদ্দিকী। শাহজিন সিদ্দিকিকে বিয়ে করেছিলেন বাবা সিদ্দিকি। তাঁদের দুই সন্তান রয়েছে। মেয়ে আর্শিয়া সিদ্দিকি পেশায় চিকিৎসক, ছেলে জিশান সিদ্দিকিও রাজনীতিতে আছেন। বর্তমানে তিনি বিধায়ক। ১৯৭৭ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন বাবা সিদ্দিকি। বম্বেতে ছাত্র পরিষদের এক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি লাইমলাইটে এসেছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি মুম্বই যুব কংগ্রেসের সভাপতি হন। এর ৪ বছর পরই, ১৯৯২ সালে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে বিহারের বাবা সিদ্দিকীর কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল মুম্বই শহর। ।
১৯৯৯ সালে, বান্দ্রা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথমবারের মতো বিধায়ক হয়েছিলেন বাবা সিদ্দিকি। ২০০৪ এবং ২০০৯ সালেও তিনি পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন। বিলাসরাও দেশমুখের নেতৃত্বাধীন সরকারে, খাদ্য সরবরাহ এবং শ্রম দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এক সময়, মহারাষ্ট্র হাউজিং অ্যান্ড এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মুমবাই বিভাগের চেয়ারম্যানও ছিলেন বাবা সিদ্দিকি। এই বছরই, কংগ্রেসের সঙ্গে ৪৮ বছরের দীর্ঘ সম্পর্ক ভেঙে অজিত পওয়ারের এনসিপি দলে যোগ দিয়েছিলেন বাবা সিদ্দিকি।
রাজনৈতিক সংস্রবের পাশাপাশি, বেড়েছিল বাবা সিদ্দিকির বলিউড ঘনিষ্ঠতা। তিন-তিনবার বান্দ্রা পশ্চিমের বিধায়ক ছিলেন তিনি। অধিকাংশ বলিউড তারকারা এই এলাকাতেই থাকেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই, চলচ্চিত্র জগতের মানুষদের কাছে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর দেওয়া ইফতার এবং রমজান পার্টিতে, সলমন খান, শাহরুখ খানের মতো প্রথম সারির বলি তারকাদের দেখা যেত। এমনকি বছর পাঁচেক আগে, শাহরুখ খান এবং সলমন খানের দ্বন্দ্বের অবসানও বাবা সিদ্দিকিই ঘটিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বাবা সিদ্দিকির মৃত্যুর পর শ্রধা জানাতে এসেছিলেন সলমন।
এদিকে, গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে মুম্বইয়ে মাথাচাড়া দেয় সংগঠিত অপরাধ। নয়ের দশকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দাপট চরমে উঠেছিল। যখন-তখন প্রকাশ্যে গুলি চলত। নাগরিক, রাজনীতিবিদ এবং এমনকি পুলিশও অপরাধ জগতের ভয়ে কাঁপত। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা, প্রযোজক এবং এমনকি পুলিশকর্তাদেরও নিশানা করা শুরু করেছিল অপরাধীরা। ১৯৯১-এ আন্ধেরির স্বাতী বিল্ডিংয়ে পুলিশ এবং গ্যাংস্টার মায়া দোলাসের মধ্যে সংঘর্ষ, ১৯৯৩ সালের মুম্বই ধারাবাহিক বিস্ফোরণ তো ছিলই, ১৯৯৭-এ টি-সিরিজের মালিক গুলশান কুমারের হত্যাকাণ্ড বুঝিয়ে দিয়েছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাত কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। এক মন্দিরের বাইরে ১৬বার গুলি করা হয়েছিল। পুলিশি তদন্তে, সঙ্গীত রচয়িতা নাদিম আখতার সইফি-সহ বেশ কয়েকজন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তির নাম উঠে এসেছিল। পরবর্তীকালে, প্রীতি জিন্টার মতো প্রথম সারির নায়িকা জানিয়েছিলেন, তোলা চেয়ে তাঁকে কীভাবে হুমকি দিয়েছিল গ্য়াংস্টাররা।
তবে, নয়ের দশকের শেষদিকে, পুলিশি প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রভাব ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। সংগঠিত অপরাধের মোকাবিলায়, মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অব অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট বা মকোকা (MCOCA) এর মতো আইন চালু করা হয়। ১৯৯৮ সালে, প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুষমা স্বরাজ ফিল্ম প্রোডাকশনকে একটি ‘ইন্ডাস্ট্রি’র স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। যার ফলে, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আর তহবিলের জন্য অপরাধ জগতের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয়নি, বৈধ তহবিল পাওয়ার অধিকার পেয়েছিল তারা। তাই, বলিউডের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সংযোগ অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।
তবে, বলিউডে যে অপরাধ জগতের মুঠি পুরোপুরি আলগা হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ ছিল ২০১৩ সাল বাবা সিদ্দিকে করা দাউদ ইব্রাহিমের সেই হুমকি ফোন। একসময়, বলিউড এবং কুখ্যাত আন্ডারওয়ার্ল্ডের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তিনি কাজ করতেন বলে মনে করেন অনেকে। তাদের দাবি, বলি অভিনেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে যেত আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনরা। সিদ্দিকির মাধ্যমে বলি তারকাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা তাদের পক্ষে সুবিধার ছিল। তবে, ২০১৩ সালে দাউদের ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন বাবা সিদ্দিকি।
এক খণ্ড জমির অধিকার নিয়ে, বাবা সিদ্দিকির সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল আহমেদ ল্যাংড়া নামে এক গ্যাংস্টারের। ছোটা শাকিল এবং দাউদ ইব্রাহিমের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন আহমেদ ল্যাংড়া। শোনা যায়, প্রথমে বাবা সিদ্দিকিকে ফোন করেছিল ছোটা শাকিল। বাবাকে সে বলেছিল, “বিষয়টা থেকে দূরে থাকুন, না-হলে ফলাফল ভাল হবে না।” কিন্তু, এতে পিছিয়ে যাননি বাবা সিদ্দিকি। ছোটা শাকিলের এই হুমকি ফোনের বিষয়ে মুম্বই পুলিশে অভিযোগ জানান বাবা সিদ্দিকি। এরপর, আহমেদ ল্যাংড়াকে গ্রেফতার করেছিল মুম্বই পুলিশ। এতেই দাউদ ইব্রাহিমের কোপে পড়েছিলেন বাবা সিদ্দিকী। ছোটা শাকিলের হুমকি ফোনের বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ জানানো এবং আহমেদ ল্যাংড়া গ্রেফতার হওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়েছিল দাউদ। এরপর ক্ষুব্ধ ডি কোম্পানির প্রধান ওই হুমকি ফোন করেছিল বাবা সিদ্দিকিকে।
সন্ত্রাসবাদীদের তহবিল জোগান এবং দেশবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে বাবা সিদ্দিকির বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। অডির তদন্তকারীরাও জানিয়েছিল, দাউদের গ্যাংয়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২০১৮ সালে, ইডি তাঁর ৪৬২ কোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছিল। এক ২,০০০ কোটি টাকার বস্তি কেলেঙ্কারির সঙ্গেও বাবা সিদ্দিকির যোগ ছিল বলে সন্দেহ করেছিল ইডি। শেষ পর্যন্ত এই দাউদ ঘনিষ্ঠতার অভিযোগই তাঁর কাল হল।