মুম্বই: বুধবার রাতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন উদ্ধব ঠাকরে। তারপর থেকে সকলেই জানতেন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে ফিরে আসছেন দেবেন্দ্র ফড়ণবীসই। এমনকি, রাজ্য বিজেপির পক্ষ থেকেও টুইট করে সেই রকমই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। টুইটটিতে একটি ভিডিও ক্লিপ ছিল, যেখানে ফড়ণবীসকে বলতে শোনা গিয়েছিল ‘মহারাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য আমি আবার ফিরে আসব’। ২০১৯ সালে তাঁর ৫ দিনের মুখ্যমন্ত্রিত্বের পর, ইস্তফা ভাষণের অংশ। তবে, এদিন ফের এক নাটকীয় মোচড়ে বদলে গিয়েছে মহা-নাটকের চিত্রনাট্য। মহারাষ্ট্র পেল নয়া মুখ্যমন্ত্রী, একনাথ শিন্ডে। দেবেন্দ্র ফড়ণবীস নিজেই রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শিন্ডের নাম ঘোষমা করেন। প্রথমে সরকারে অংশ নেবেন না বলেও, পরে জেপি নাড্ডার অনুরোধে নয়া সরকারে উপ-মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন ফড়ণবীস। শিন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার খবর, অনেককেই বিস্মিত করেছে। তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের পিছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক সমীকরণ রয়েছে। কেন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেন না ফড়ণবীস? কেন এগিয়ে দিলেন শিন্ডেকে?
ফের মুখ না পোড়ে
২০১৯ সালে জোট বেঁধে লড়েও, বিধানসভা নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে জোট ভেঙে গিয়েছিল বিজেপি এবং শিবসেনার। মহা আগাড়ি জোট তৈরির কথা চলার মধ্য়েই এনসিপির অজিত পওয়ারের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস। তবে, তাড়াহুড়ো করা এই পদক্ষেপে মুখ পুড়েছিল ফড়নবীসেরই। ৫ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ক্ষীণ হলেও, এইবারও সেই সম্ভাবনা রয়েছে। রাজ্যে ফেরার পর বিদ্রোহীরা সকলেই শেষ পর্যন্ত শিন্ডে শিবিরে নাও থাকতে পারেন।
বিজেপির ভাবমূর্তি
২০১৯ সালের ওই ঘটনায় শুধু যে দেবেন্দ্র ফড়ণবীসের মুখ পুড়েছিল তাই নয়, বিজেপির ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ক্ষমতালোভী’ অভিযোগ তোলার হাতিার পেয়ে গিয়েছিল বিরোধীরা। একনাথ শিন্ডেকে এগিয়ে দেওয়ার ফলে, বিজেপিকে চেয়ারের প্রত্যাশী – এই কথা বলার আর জায়গা রইল না।
উদ্ধব বনাম দেবেন্দ্র
২০১৯ সালের তিক্ত বিচ্ছেদের পর, বিজেপি বারবারই বলেছে, দ্বন্দ্বটা বিজেপি বনাম শিবসেনা নয়। বরং, উদ্ধব বনাম দেবেন্দ্রর। বস্তুত, জোট বেঁধে সরকারে থাকার সময়ও উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে ফড়নবীসের সম্পর্ক মসৃণ ছিল না। শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে ফড়ণবীস আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন, লড়াইটা শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির ছিল না। উদ্ধবের অহং-এর কারণেই ভেঙেছিল জোট।
মুখ্যমন্ত্রীর পদে ‘শিবসৈনিক’
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিদায়ী ভাষণে উদ্ধব ঠাকরে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বালাসাহেবের ছেলেকে অপমানিত’ করার অভিযোগ করেছিলেন। ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ে বিতর্কের সময়ও বারবার করে শিবসেনার পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে একজন ‘শিবসৈনিক বসবেন’ এই আবেগমণ্ডিত আখ্যান তুলে ধরা হয়েছিল। শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার দিয়ে, মুখ্যমন্ত্রীর পদে একজন ‘শিবসৈনিকের’ থাকাটা নিশ্চিত করলেন ফড়ণবীস। কাজেই বালাসাহেবের উত্তরাধিকারকে অপমান করার যে আখ্যান তুলে ধরে রাজনৈতিক লাভ পেতে চেয়েছিলেন উদ্ধব, তা এখন আর কার্যকর হবে বলে মনে হয় না।
বালাসাহেবের উত্তরাধিকার
শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করার সময়ও দেবেন্দ্র ফড়নবীস বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে একজন ‘শিবসৈনিক থাকা নিয়ে বালাসাহেবের স্বপ্ন পূরণ হল।’ এই বক্তব্যের মধ্যে একটা অন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। বস্তুত, বালাসাহেবের উত্তরাধিকার নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন একনাথ শিন্ডে। অভিযোগ করেছিলেন, বাল ঠাকরের হিন্দুত্বের পথ থেকে সরে এসেছেন উদ্ধব। শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার দিয়ে ‘বাল ঠাকরের স্বপ্ন পূরণ’ করে বালাসাহেবের প্রকৃত উত্তরাধিকার বিজেপিই বহন করছে, মহারাষ্ট্রবাসীকে সূক্ষ্মভাবে এই বার্তাও দিয়ে রাখলেন ফড়নবীস।
সরকারের স্থায়ীত্ব
সংখ্যার বিচারে মহারাষ্ট্রের নয়া শাসক জোটের ‘বড়দা’ অবশ্যই বিজেপি। সেই দিক থেকে, দেবেন্দ্র ফড়ণবীসেরই নয়া মহা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল। তবে, সেই ক্ষেত্রে সরকারে স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকত। আজ যে শিবসেনা বিধায়করা এক কথায় উদ্ধব ঠাকরেকে ছেড়ে একনাথ শিন্ডের শিবিরে এসে ভিড়েছেন, তাঁরা যে ফের ‘বিদ্রোহী’ হবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী থাকলে এই বিদ্রোহ যে কোনও দিন দেখা যেতে পারে। শিন্ডে মুখ্যমন্ত্রী হলে এই বিধায়করা অন্তত নিজেদের দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের আছেন মনে করে জোটবদ্ধ থাকতে পারেন।
পুতুল সরকার
শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী হলেও, সরকারের আসল রাশ যে ফড়ণবীস তথা বিজেপির হাতেই থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এমনিতেই, এত বড় পদে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই শিন্ডের। তার উপর তাঁর ডেপুটি আবার দুইবারের মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে সংখ্যায় বিপুল এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। শিন্ডে শিবিরের হাতে সত্য়ি সত্যি কত সংখ্যা রয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আর যাই হোক, অল্প সংখ্যা নিয়েও নীতীশ কুমার হয়ে ওঠা শিন্ডের পক্ষে সম্ভব নয়।