শান্তিনিকেতন: ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে শান্তিনিকেতন। বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের পাশে এই ছোট্ট শহরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই শান্তিনিকেতনকে জ্ঞানচর্চার পীঠস্থানে পরিণত করেছিলেন তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ১৯২৫-এ এর নাম হয় পাঠভবন। আর ১৯২১-এ রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্বভারতীর। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান ছিল একটি কলেজ। ১৯৫১ সালে এটিকে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়েছিল। কিন্তু, কেন হঠাৎ একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? কী ভাবনা কাজ করেছিল এর পিছনে?
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী গ্রন্থে, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর শিক্ষা-চিন্তা ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে শিক্ষার চর্চা রয়েছে। মানসিক শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্বের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু, দখল করার পর, ইউরোপীয় শক্তি আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল, তার সঙ্গে মনের কোনও যোগ ছিল না। তা ছিল অনুকরণ করার শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথের মতে, দেশিয় শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ার একমাত্র কারণ ছিল ভেদাভেদ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রীষ্টান ধর্মভেদে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় মন। আর সেই কারণেই কিছু গ্রহণ বা দান করার মতো জায়গায় নেই ভারতীয়রা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, এই সকল ভেদাভেদ দূর করে ভারতের ‘মানসিক সম্পদ’কে একত্রিত করতে। তিনি লিখেছেন, “দশ আঙুলকে যুক্ত করিয়া অঞ্জলি বাঁধিতে হয় – নেবার বেলাও তাহার প্রয়োজন, দেবার বেলাও।” সমগ্রতা উপলব্ধি করতে না পারলে শিক্ষা গ্রহণ, ভিক্ষা গ্রহণের মতো হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ বিদ্যার উৎপাদন, উদ্ভাবন। বিদ্যাদান তাঁর মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌন কাজ। তিনি তাই চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে শিক্ষক নয়, উদ্ভাবক, আবিষ্কারক, স্রষ্টাদের একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “তাঁহারা যেখানেই নিজের কাজে একত্র মিলিত হইবেন, সেইখানে স্বভাবতই জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হইবে, সেই উৎসধারার নির্ঝরিণীতটেই দেশের সত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হইবে।”
ইংরেজরা, ভারতে যে মেকলের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটা কেরানি শ্রেণি তৈরি করা। যারা ইংরেজদের নিত্যদিনের কাজকর্ম চালাতে সহায়ক হবে। তাই, বিংশ শতকের শুরুতে ভারতে শিক্ষার সঙ্গে যোগ ছিল শুধুমাত্র, কেরানি, উকিল, চিকিৎসক, দারোগার মতো কয়েকটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষের সঙ্গে। দেশের কৃষক, শ্রমিক, কুমোরদের সঙ্গে শিক্ষার কোনও যোগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মতে, ইংরেজদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে মাটির কোনও যোগ ছিল না বলেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এর বিপরীতে তিনি চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা, যার সঙ্গে দেশের সর্বাঙ্গীন জীবনযাত্রার যোগ থাকবে। তিনি লিখেছিলেন, “ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তবে গোড়া হইতেই সেই বিদ্যালয় তাহার অর্থশাস্ত্র, তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা, তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠাস্থানের চতুর্দিকবর্তী পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্রস্থান অধিকার করিবে।”
মূলত, এই তিন ভাবনা থেকেই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ভারতে যে ব্রিটিশ অনুকরণের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল, তারই বদল ঘটিয়ে দেশিয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন তিনি। যে, শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যোগ থাকবে দেশের মাটির। যে শিক্ষা ব্যবস্থা কাজে লাগবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের। আর এই শিক্ষা চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল বিশ্বভারতীর।