Baghajatin House Lifting Explained: প্রোমোটার না স্থাপত্যকার! কলকাতায় দিকে দিকে ‘পিসার হেলানো মিনার’! আদৌ সম্ভব বাড়ি সোজা করা?

Jan 15, 2025 | 6:23 PM

Baghajatin House Lifting Explained: এবার প্রশ্ন বাড়ি লিফটিং কী? TV9 বাংলা কথা বলেছিল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস । তিনিই খুব সহজ করে বিষয়টি বোঝান। ধরুন, রাস্তায় যদি গাড়ি খারাপ হয়ে যায়, চার চাকার গাড়ি।

Baghajatin House Lifting Explained: প্রোমোটার না স্থাপত্যকার! কলকাতায় দিকে দিকে পিসার হেলানো মিনার! আদৌ সম্ভব বাড়ি সোজা করা?
আদৌ কি সম্ভব বাড়ি লোজা করা?
Image Credit source: TV9 Bangla

Follow Us

কলকাতা: দক্ষিণ কলকাতার বাঘাযতীনের ৯৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্যাসাগর কলোনি। সেই কলোনিরই ‘শুভ অ্যাপার্টমেন্ট’ মঙ্গলবার দুপুরে দেখিয়ে দিল অশুভ চরিত্র! হেলে পড়ল আস্ত একটি ফ্ল্যাটবাড়ি। নাহ, কোনও পুরনো আবাসন নয়। একেবারেই ঝাঁ চকচকে একটা আবাসন। ওই আবাসনে ৬টি পরিবারের বাস। কিন্তু তাঁরা কেউই নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকছিলেন না। পুজোর সময় থেকেই তাঁরা এলাকাতেই ভাড়া বাড়িতে থাকছিলেন। কেন? কেনই বা ভেঙে পড়ল নতুন একটা আবাসন। এর পিছনেই যত রহস্য।

আবাসন-বৃত্তান্ত

জানা যাচ্ছে,  ২০১২ সালে এই আবাসন তৈরি হয়। মোট ছয়টি পরিবার ফ্ল্যাট কেনেন এই আবাসনে। দুটি ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল এবং সেই দুটি প্রোমোটার সুভাষ রায় নিজের নামে রেখেছিলেন।  দুই বছর পরেই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা দেখতে পান, আবাসনের দক্ষিণ দিক বেঁকে হেলে গিয়েছে।

বিষয়টি আবাসনের প্রোমোটার সুভাষ রায়কে জানান তাঁরা। প্রোমোটার সুভাষ তখন সিদ্ধান্ত নেন, এই আবাসনটি লিফটিং করাবেন। প্রোমোটার বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করেন, আবাসনটি লিফটিং করালেই সোজা হয়ে যাবে। সেই মতো পুজোর আগেই ওই ৬টি পরিবার পাশেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেছিলেন।

আর তারপরই শুরু হয় বাড়ি লিফটিংয়ের কাজ। আর তাতেই বিপত্তি। যেদিন আবাসনটি বেঁকে গেল, ঠিক তার দুদিন আগেই এই লিফটিংয়ের কাজ হয়েছে।

এবার প্রশ্ন বাড়ি লিফটিং কী? 

TV9 বাংলা কথা বলেছিল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস । তিনিই খুব সহজ করে বিষয়টি বোঝান। ধরুন, রাস্তায় যদি গাড়ি খারাপ হয়ে যায়, চার চাকার গাড়ি। তখন গাড়ির পিছনে যে স্টেপনি থাকে, যে চাকাটা খারাপ হয়েছে, সেটা খোলার জন্য আলাদা একটা হাইড্রোলিক জ্যাক থাকে। সেটা দিয়ে যে চাকাটা খারাপ হয়েছে, তাকে তোলা হয়। তারপর খুলে ভাল চাকা লাগিয়ে ভালো করে টাইট করে হাইড্রোলিক জ্যাকটাকে খুলে নেওয়া হয়।

এই যে জ্যাক দিয়ে চাকাটাকে তোলা হয়, তাতে গাড়িটাও রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ওঠে। চাকাটা ঢিলে হলে সেটা বার করে আনা হয়। এটাকে বলে হাইড্রোলিক জ্যাক। এটা দিয়ে যেমন গাড়ি তোলা যায়, ঠিক তেমনি ভাবেই বাড়ি মাটি থেকে তোলার ক্ষেত্রে নীচের যে ফুটিং সেটাকেও তোলা যায়।

কিন্তু বাড়ি তোলার প্রয়োজন কেন হয়? 

বিশেষত, ফিল্ড আপ সয়েল অর্থাৎ যেগুলো ভরাট জমি, সেখানে বাড়ি তৈরি হওয়ার পর বাড়ির নীচের ফুটিং সেটেলমেন্ট করতে থাকে। মাসে বসতে থাকে। এই সেটেলমেন্টটাই যদি গোটা বাড়িটার সব ফুটিংয়ের ক্ষেত্রে একইভাবে হয়, তখন আমাদের চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু অনেক সময় জমির চরিত্রে মিশ্রণ থাকে। অর্থাৎ জমির একটা দিক ভরাট ছিল, আরেকটা দিক নয়। অর্থাৎ আরেকটা দিক কম শক্ত তুলনামূলকভাবে। এক্ষেত্রে যা হয়েছে। সফট সয়েলের দিকে যে ফাইন্ডেশনগুলো ছিল, সেগুলো সেটিং করছিল। সেই সেটিংয়ের ক্ষেত্রেই একদিকের ফুটিং বেশি বসে, অন্যদিকের তুলনায়। এই ধরনের বিষয়গুলো বলা হয় ডিফারেন্সিয়াল সেটেলমেন্ট। তখন বাড়িটা একদিকে বসে যেতে পারে। যেদিকে বেশি বসছে, সেদিকেই বেঁকে যায়। তাতে বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ক্র্যাক ফাটল দেখা যায়। ফাটল যদি দ্রুত বাড়তে থাকে, তাহলে ধরে নিয়ে হবে সেটেলমেন্টও বেশি হচ্ছে।

বাড়ির বসাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তিও রয়েছে

তবে এই বসাটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কিছু প্রযুক্তি রয়েছে। তারই একটা উপায় হল ‘লিফটিং অফ ফাউন্ডেশন’। যেগুলো ‘লোড বিয়ারিং ওয়াল’ অর্থাৎ পুরনো দিনের মোটা ইটের বাড়ির যেদিক বসছে, সেই দিকটাকে এই হাইড্রোলিক জ্যাক দিয়ে আস্তে আস্তে তোলা হয়। বাড়ির ভিতের তলার মাটি, যেটা নরম, তা শক্ত করার চেষ্টা করা হয়।

ওই নরম মাটিতে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ইঞ্জেক্ট করা হয়। সেটাকে বলা হয় গ্রাউটিং। তারপর ধীরে ধীরে সেই মাটি শক্ত করা হয়। সময় লাগে। শক্ত হওয়ার পর জ্যাকটা খুলে বাড়িটাকে নামানো হয়। পুরনো মাটি তাহলে আর বেশি বসবে না।

বাড়ি লিফটিংয়ে পাশের বাড়ি কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?

দুই বাড়ির মধ্যে এই কারণেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব ছাড়তে হয়। কারণ এই ধরনের লিফটিংয়ের ক্ষেত্রে দুই বাড়ির মধ্যের পরিসর স্বল্প হয়, যেরকম বাঘাযতীনের এই আবাসনের ক্ষেত্রে হয়েছে, পাশের বাড়িটা মাত্র দেড় হাত দূরত্বের। সেক্ষেত্রে লিফটিং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ গোটা বাড়ির ভারবাহী স্তম্ভের মধ্যে ভার মাটিতে পড়ে। মাটি সেই ভার প্রসারিত করে। ফলে তার প্রভাব পড়ে আশপাশের মাটিতে। এবার দুটো বাড়ি যদি খুবই কাছাকাছি থাকে, তাহলে এক বাড়ির ভার পাশের বাড়িতে নিশ্চিতভাবেই পড়বে। কারণ তাতে পাশের বাড়ির নীচের মাটিও বসে যেতে পারে।

বাঘাযতীনের এই আবাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও গহীন

এই আবাসন যেখানে তৈরি হয়েছে, তা আগে একটা জলাশয় ছিল। তারপর সেই জলাশয় বুজিয়ে একটা অংশে বাড়ি তৈরি হয়। সেই পুরনো বাড়ি ভেঙে আবার এই আবাসন তৈরি হয়। তার মানে প্রথমে জলাশয়ের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়। পুরনো বাড়ি জলাশয়ের কিছুটা অংশ বুজিয়ে তৈরি হয়। বাকিটা জলাশয় থাকে। কিন্তু এবার যখন আবাসন তৈরি হল, তখন সেই আবাসনের নীচে মাটির চরিত্রও ভিন্ন। নতুন করে যে জলাশয় বোজানো হল, তার তুলনায় আগে যে বাড়িটা তৈরি হয়েছিল, তার নীচের মাটি তুলনামূলকভাবে শক্ত। তার মানে একই আবাসনের নীচে দু’রকমের মাটির উপস্থিতি। ফলে নরম মাটির অংশ বসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

প্রোমোটার-চাল

একে জলাশয় বুঝিয়ে আবাসন বানিয়েছেন। সেই আবাসন বসছেন। তা নিজেই দায়িত্ব নিয়ে লিফটিং করাচ্ছেন। অথচ সে বিষয়ে একবারও পৌরসভার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। এদিকে, আবাসিকদের দিয়ে লিখিয়ে রেখেছিলেন মুচলেকা। যেখানে বয়ান ছিল, আবাসন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁর। কিন্তু লিফটিং করাতে গিয়ে কোনও সমস্যা হলে, তার দায় আবাসিকদেরই। তাই লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ফ্ল্যাট কিনে, উল্টে তাঁদের বিরুদ্ধে নেতাজিনগর থানায় হল এফআইআর। আর প্রোমোটার পলাতক। ২০২৪ সালের ১৭ মার্চ মাঝরাতে গার্ডেনরিচে বেআইনি নির্মীয়মাণ বাড়ি ভেঙে পড়ে। সেই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন মানুষ।  এখানেও যে নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি, তাও ক্রমশ প্রকাশ্য।

মেয়র হুঁশিয়ারি

মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, “কলোনি এলাকায় যে যার নিজের বাড়ি করে নিচ্ছে, সেই বাড়িগুলোর স্ট্রাকচারাল স্টেবিলিটি রয়েছে কিনা, সেটা দেখা হচ্ছে না। এখানে প্ল্যান নেওয়ার নিয়মই নেই। পুরনো প্ল্যানগুলোর ক্ষেত্রেও খতিয়ে দেখা উচিত। ভাগ্য ভালো কেউ বাড়িতে ছিলেন না।” তবে তিনি এক্ষেত্রেও বামেদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘বাম আমলের পাপের বোঝা বইতে হবে।’ তাতে প্রাক্তন বাম কাউন্সিলর চয়ন ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের নাকি দূরবিন দিয়ে দেখা যায় না, এখন সব জায়গায় বামফ্রন্টের ভূত দেখছেন। মেয়র ভুলে গিয়েছেন, এই নির্মাণ শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। তখন ওঁর দল পৌরসভায় চলে এসেছে। জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণ ওঁরাই করেছিলেন।”

প্রশাসন পদক্ষেপ

অভিযুক্ত প্রোমোটার ও তাঁর ছেলে,  যে সংস্থা এই আবাসন টিকে লিফটিংয়ের কাজ করছিল, অর্থাৎ ‘নায়াগ্রা হাউজ লিফটিং’ এর বিরুদ্ধে নেতাজি নগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে কলকাতা পৌরসভা। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে বহুতল নির্মাণের পর ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে তারপর বসবাসের অনুমতি নিতে হয়। এই আবাসনের ক্ষেত্রে যাবতীয় বিষয় অবজ্ঞা করা হয়েছে। সেকারণেই বিল্ডিং বিভাগের তরফে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।

Next Article