কলকাতা: মরণোত্তর দেহদান করতেই চেয়েছিলেন বরানগরের সাতান্ন বছরের বাসিন্দা তপনবাবু ওরফে তপন কুমার জানা। কিন্তু বাধ সেধেছিল কোভিড (COVID19)। গত ১৪ মে করোনা আক্রান্ত হয়ে হয়ে বেলঘড়িয়ার জেনিথ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তপনবাবু। এরপর গত ২৪ মে হাসপাতালেই মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর স্পষ্টতই সম্পূর্ণ দেহদান যে সম্ভব নয়, তা স্পষ্টই ছিল। কিন্তু, কেবল কোভিডে আক্রান্ত রোগীর মতো দাহকার্যের পক্ষপাতী ছিলেন না তপনবাবুর পরিবার। বাবার স্বপ্ন মাথায় নিয়ে তাই তপনবাবুর দেহ অটোপসি (Autopsy) করানোর সিদ্ধান্ত নেন ছেলে তন্ময় জানা। পাশে পেলেন ‘উদয়ের পথে’ (Udayer Pathe) নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে।
কিন্তু, কোভিড রোগীর অটোপসি সহজ কথা নয়। করোনা নিয়ে যেখানে রীতিমতো আতঙ্কিত মানুষ, এমনকী, করোনায় মারা গেলে সামান্য দাহকাজেও বিস্তর সমস্যা তখন, এহেন ময়নাতদন্ত যে কার্যত ‘আকাশকুসুম কল্পনা’ এমনটাই মনে করেছেন অনেকে। কিন্তু হাল ছাড়েননি তন্ময়বাবু। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী, হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটিই কোভিড মৃতদেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে পারবে। কিন্তু, অটোপসি করাতে গেলে মৃতদেহ পৌঁছে দিতে হবে আর জি কর হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে। সেইমতো, কামারহাটি মিউনিসিপ্যালিটি লিখিত দেন তন্ময়বাবু। কিন্তু, কামারহাটির পুরপ্রশাসক এতে আমল দেননি। এরপর সরাসরি আর জি কর হাসপাতালের (R G Kar Hospital) ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান ডাঃ গৌতম দাস, জেনিথ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের এম ডি ডাঃ পার্থ প্রতীম শেঠ ও গণদর্পণ-এর সম্পাদক শ্যামল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করেন তন্ময়বাবু। গণদর্পণ ও হাসপাতালের তরফে সাড়া মিললেও সায় দেয়নি পুরপ্রশাসন।
বাবার ইচ্ছে পূরণের সব রাস্তা যখন এক এক করে তন্ময়বাবুর কাছে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন পাশে পেলেন, ‘উদয়ের পথে’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। রাত বারোটার সময়ে, উদয়ের পথের সম্পাদক তন্ময়বাবুর কথা জানতে পেরে তাঁকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। অবশেষে, তাঁর সহায়তায় মঙ্গলবার আর জি করের ফরেনসিক বিভাগে তপনবাবুর দেহ পাঠানো হয়। আটচল্লিশ ঘণ্টা পেরলেই তপনবাবুর মৃতদেহ অটোপসি করা হবে বলে জানিয়েছে আর জি কর হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। যতক্ষণ না অটোপসি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত হাসপাতালের মর্গে নিখরচায় তপনবাবুর দেহ রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন জেনিথ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের এম ডি চিকিৎসক পার্থ প্রতীম শেঠ।
অবশেষে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে খুশি তন্ময়বাবু। এই কাজের সিংহভাগ কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন ‘উদয়ের পথে’-এর সম্পাদক প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার উৎপল চট্টোপাধ্যায় ও গণদর্পণের সম্পাদক শ্যামল চট্টোপাধ্যায়কে। শ্যামলবাবু এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি আচমকাই ফোন পেয়েছিলাম তন্ময়ের। ওর বাবা মারা যাওয়ার আগেই ও আমায় ফোন করে। জানায়, তপনবাবুর মৃতদেহ অটোপসি (Autopsy) করাতে চায়। আমি খানিক অবাক হই। সেই মুহূর্তে ওকে নিরস্ত করি। পরে ওর বাবা মারা গেলে তখন আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি। এই পরিস্থিতিতে, অটোপসি করানোর মতো এত বড় সিদ্ধান্ত যে নিয়েছেন তপনবাবুর স্ত্রী ও তাঁর ছেলে, তারজন্য তাঁদের কুর্নিশ।” অন্যদিকে, কৃতজ্ঞ তন্ময়বাবু বলেন, “এত কিছু ভাবিনি। বাবার ইচ্ছেটা জানতাম। আমরা চেয়েছিলাম, আর কিছু না চিকিৎসাবিজ্ঞানের নূন্যতম কাজেও যদি লাগতে পারে বাবার মৃতদেহ, তাহলে এর থেকে বেশি আর কিছুতে খুশি হব না। তাই অটোপসির সিদ্ধান্ত নিই।”
কোভিডে মৃত রোগীর অটোপসি হয়েছে, এই তালিকায় তপন কুমার জানা চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। এর আগে, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান অঙ্গদান আন্দোলনের কর্মী ব্রজ রায়। প্রথম পূর্ব ভারতে, আর জি কর হাসপাতালেই প্যাথলজিকাল অটোপসি হয় ব্রজ রায়ের। এ বার সেই তালিকায় এলেন তপন কুমার জানা।
আরও পড়ুন: বেতন-সহ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, করোনায় মৃত কর্মীর পরিবারের দায়িত্ব নেবে টাটা