নাম তাঁর অর্জুন। বিশ্বে এমন কোনও শক্তি নেই তাঁর প্রাণ নিতে পারে! যাঁর তূণে পশুপাতাস্ত্র, রুদ্রাস্ত্র, ব্রহ্মশিরা অস্ত্র বা ব্রহ্মাস্ত্র রয়েছে, তাঁকে মাত্র ‘রাশিয়ান বিষ’ দিয়ে মারা যায়? এই প্রশ্ন উঠত যদি কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিন বা বাংলার তৃণমূল অর্জুনের প্রতিপক্ষ হত। কিন্তু আমরা মহাভারতে কথা বলছি না, আমরা ভারতের কথা বলছি, যেখানে অর্জুনের মতো ‘বাহুবলী’ রাজনৈতিক নেতাকে ‘রাশিয়ান বিষ’ দিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর অভিযোগ। এই ‘রাশিয়ান বিষ’ খায় না মাথায় দেয়, সে বিষয়ে বলার আগে ভাটপাড়ার দাবাং বিজেপি নেতা অর্জুন সিংয়ের ঠিক অভিযোগ সেটা আগে বোঝা যাক। তিনি দাবি করেছেন, তাঁকে এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা এই মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপি অন্যতম প্রথম সারির নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে ‘রাশিয়ান বিষ’প্রয়োগ করে মারা চেষ্টা করা হতে পারে। শুধু আশঙ্কাই করেননি, সত্যি কি প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা, তা জানতে পরীক্ষাও করিয়েছেন অর্জুন সিং। আবার সেই ভয়ে বিজেপি নেতার হাতে দেখা যাচ্ছে দামি অ্যালকালাইন জল। যার এক বোতলের দামই এক হাজার টাকার উপরে। কিন্তু কেন হঠাৎ রাশিয়ান বিষ নিয়ে মাথাব্যথা হল অর্জুন সিংয়ের? কী এই রাশিয়ান বিষ? বাংলাতে কি সত্যিই আমদানি হয়েছে?
সম্প্রতিই ভাটপাড়া পুরসভার দুর্নীতির তদন্ত করতে বিজেপি নেতা অর্জুন সিংকে তলব করেছিল সিআইডি। সেই হাজিরা দিতে যাওয়ার সময়ই অর্জুন সিংয়ের মুখে ‘রাশিয়ান বিষে’র কথা প্রথম শোনা যায়। তাঁকে ও শুভেন্দু অধিকারীকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে দাবি করেন। বলেন যে খাবার, জল বা চেয়ারে বিষ লাগানো থাকতে পারে। স্লো-পয়েজনিংয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এরপরে শনিবার, ১৬ নভেম্বর শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চেক আপের জন্যও যান। হাসপাতালে দাঁড়িয়েই বলেন, “এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত। যারা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করছে, তারা আসলে মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। আমার কাছে তথ্য আছে বলেই চেক আপে এসেছি“। এই নিয়ে আবার তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ কটাক্ষ করে বলেছেন, “কোন কেমিক্যাল মানুষের জন্য ক্ষতিকর, কোনটা কী ভাবে কাজ করে, অর্জুনের তা নিয়ে ভাল অভিজ্ঞতা রয়েছে।”
এ তো গেল অর্জুন সিংয়ের কথা। কিন্তু এই রাশিয়ান বিষের ভয় তৈরি হল কেন দাপুটে নেতার মনে? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেই রহস্য তৈরি করেছিল রোমান আব্রামোভিচের মৃত্যু। চলতি বছরের মার্চ মাসে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে গিয়েছিলেন রাশিয়ান বিলিওনিয়ার। যুদ্ধ থামাতে দুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যস্থতা করতে। কিন্তু সেখানেই অদ্ভুতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাশিয়ান ধনকুবের। চোখ জবার মতো লাল হয়ে যায়। মুখ-হাত পা থেকে চামড়া উঠতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার জন্য দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন। এরপরই মৃত্যু।
কেন পুতিন ঘনিষ্ঠ এই ধনকুবের যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করছিলেন, তা যেমন রহস্য, তার থেকেও বেশি রহস্যজনক কীভাবে তাঁর মৃত্যু হল। পশ্চিমি গোয়েন্দাদের অনুমান ছিল, আব্রামোভিচের মৃত্যুর আগে যে উপসর্গ দেখা গিয়েছিল, তা ক্রেমলিনের বহু চর্চিত বিষ দিয়ে হত্যার ফন্দির মতোই। তাঁর শরীরে যে উপসর্গগুলি দেখা গিয়েছিল, তা পরফিরিন, অর্গানোফসফেটের মতো কোনও বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতিতেই দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষের মাত্রার উপরে উপসর্গ নির্ভর করে। সাধারণত প্রাণঘাতী না হলেও, অনেক সময়ই শরীরে একের পর এক অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকল হয়ে যায়, যা স্থায়ীভাবে ক্ষতি করতে পারে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সুখ্যাতি যেমন রয়েছে, তেমন কুখ্যাতিও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললেই বা না-পসন্দ হলেই নাকি তাদের নোভিচক বিষ দিয়ে মেরে ফেলেন বা মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। অতীতেও রাশিয়ার সিক্রেট সার্ভিস কেজিবির বিরুদ্ধে এই বিশেষ নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
অর্জুন সিংয়ের ভয় কিন্তু অমূলক নয়। এর পিছনে রয়েছে যথেষ্ট কারণ। ১৯৯৫ সালে রাশিয়ান ব্যাঙ্কার ইভান কিভেলিদির মৃত্যু হয়। তিনি সেই সময়ের রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর চেরোনোমিরদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বিষক্রিয়াতেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। মনে করা হয়, মস্কোয় কিভেলিদির অফিসে রাখা টেলিফোনে নোভিচক বিষ লাগানো ছিল। সেই ফোন কানে দিতেই শরীরে বিষ ঢোকে। ধীরে ধীরে তা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এক মাস পর কিভেলিদির সেক্রেটারি জ়ারা ইসমাইলোভারও একই উপসর্গ দেখা দেয়। হাসপাতালে ভর্তির একদিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়।
রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক তদন্ত করে জানিয়েছিল, মিলিটারি গ্রেড নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করেই হত্যা করা হয়েছিল দুইজনকে। এই নার্ভ এজেন্টের ফর্মুলা ক্লাসিফায়েড। কারোর জানার অধিকার নেই।
তবে নোভিচকের আমদানি কিন্তু নতুন নয়। ১৯৭০-র দশক থেকেই রাশিয়া এই গোপন অস্ত্র ব্যবহার করত। অন্তত এমনটাই দাবি রুশ রসায়নবিদদের। ১৯৯২ সালে মসকোভস্কিয়ে নভোস্তি (Moskovskiye Novosti) সাপ্তাহিক পত্রিকাতেই দাবি করা হয় যে ১৯৭০ থেকে ১৯৯০-র দশকের গোড়া পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন চতুর্থ প্রজন্মের কেমিক্যাল অস্ত্র তৈরি করেছে। পশ্চিমি দুনিয়ারও মদত ছিল এই অস্ত্র তৈরিতে। এমনভাবেই বিষ ব্যবহার করা হত যে বিদেশি চর বা স্পাই-রা টেরও পেতেন না। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হত তাদের।
শোনা যায়, নোভিচক রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতেও ব্যবহার করা হত। পাঁচ ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ব্যবহার হত, এর মধ্যে সবথেকে চর্চিত ছিল এ-২৩২ (নোভিচক-৫) এজেন্ট। তবে কখনও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে এই বিষ ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৮ সালে ব্রিটেন সরকার দাবি করে, সালিসবারিতে সার্গেই ও তাঁর কন্যা ইউলিয়ার স্ক্রিপালোর বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর পিছনে এই নোভিচকই ব্যবহার করা হয়েছিল। এর চার মাস পর আমিসবেরিতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। একজনের মৃত্যু হয় বিষে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরেন তিনজন। যদিও তখন রাশিয়া সরকার অস্বীকার করেছিল যে তারা নোভিচক নামে কোনও বিষ বা রাসায়নিকের উৎপাদন তো দূর, গবেষণাও করে না। এরপরে ২০২০ সালে জার্মান সরকার অ্যালেক্সি নাভালনি নামক একজন পুতিন বিরোধী অ্যাক্টিভিস্টের বিমানে হঠাৎ মৃত্যুর পিছনে নোভিচক বিষ ব্যবহার করা হয়েছিল।
গত ২০ অগস্ট সার্বিয়ায় ঘুরতে গিয়ে মৃত্যু হয় অ্যালেক্সি নাভালেনির। এই নাভালেনি আবার পুতিনের সমালোচক ছিলেন। জার্মান চিকিৎসকরা দাবি, রাশিয়ার তৈরি এই বিশেষ বিষ প্রয়োগ করেই হত্যা করা হয়েছিল। এরপরই একে একে রাশিয়ার কর্মকাণ্ড ফাঁস হতে থাকে। ১৯৭০-র দশকে নোভিচক তৈরি হলেও সম্প্রতিই রাশিয়া ফের সেই বিষ ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ। ২০১৮ সালে রাশিয়ার প্রাক্তন মিলিটারি গোয়েন্দা প্রধান সার্গেই স্ক্রিপালককে হত্যা করা হয়।
সমালোচকদের মতে, নোভিচক অধিকাংশ সময় প্রাণে মারতে ব্যর্থ হলেও, পুতিন জোর দেন এই বিষ ব্যবহারেই, কারণ তিনি বিশ্বকে পরোক্ষে জানান দিতে চান যে এই ঘটনার পিছনে রাশিয়ার যোগ রয়েছে। এতে সকলের মনে, বিশেষ করে পুতিন বিরোধীদের মধ্যে যাতে ভয় তৈরি হয়।
বিষ প্রয়োগের দুই-তিন মাস বাদে প্রভাব দেখা দেবে, এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজেপি নেতা অর্জুন সিং। এই বিষয়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ সোমনাথ দাসের সঙ্গে কথা বলে টিভি৯ বাংলা। তিনি বলেন, “তিন ধরনের পদ্ধতিতে বিষ প্রয়োগ করা হতে পারে। কেউ যদি বিষ পান করেন, দ্বিতীয় কেউ যদি বিষাক্ত গ্যাস শোঁকেন এবং তৃতীয়, কেউ যদি বিষের সংস্পর্শে আসেন। তৃতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিষের সংস্পর্শে এলে মৃত্যুর সম্ভাবনা সবথেকে কম বা সবথেকে বেশি সময় লাগতে পারে।”
রাশিয়ান বিষ কি সত্যি আছে? এই প্রশ্নে সোমনাথবাবু বলেন, “রাশিয়ান বিষ বলে আসলে কিছু হয় না। রাশিয়া মোটেও বিষের জন্য বিখ্যাত নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লিউসাইড গ্যাস নামে এক ধরনের গ্যাস আবিষ্কার করা হয়, যা ওয়ার গ্যাস হিসাবে পরিচিত ছিল। মূলত রাশিয়ানরা এই গ্যাস ব্যবহার করত বলেই তাদের দুর্নাম।”
তবে অর্জুন সিং যে দাবি করছেন, তার প্রেক্ষিতে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ বলেন, “কেউ বিষ খেলেন , তার ফল দুই মাস বাদে দেখা গেল, এমন বিষের কথা জানা নেই। কোনও বিষের ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া সবথেকে দ্রুত হয় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানোয়। দুই মাস বাদে বিষের প্রভাব বোঝা যাবে, এর জন্য ক্রনিকালি অর্থাৎ প্রতিদিন অল্প করে বিষ দিতে হবে।”
তবে অর্জুন সিং বাংলায় এই রাশিয়ান বিষ আনার যে দাবি করেছেন, তার পিছনে শাসক দল বা অন্য কারোর যোগ রয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।