মেডিক্যালে ‘ইকমো’ আছে, কিন্তু তা চালাবেন কে? মোটা অঙ্ক খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালই ভরসা

Dec 26, 2020 | 5:07 PM

স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, “ওখানে তো দু’টি ইকমো রয়েছে! আমি ব্যক্তিগত স্তরে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম।”

মেডিক্যালে ইকমো আছে, কিন্তু তা চালাবেন কে? মোটা অঙ্ক খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালই ভরসা
ফাইল চিত্র।

Follow Us

সৌরভ দত্ত: রাজ্যের প্রথম সারির সরকারি কোভিড হাসপাতাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফুসফুসে সংক্রমণের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্র ইকমো (এক্সট্রা কর্পোরিয়াল মেমব্রেন অক্সিজেন) থাকলেও তা চালানোর জন্য প্রশিক্ষিত পর্যাপ্ত ‘যন্ত্রী’ নেই। স্বাস্থ্যভবন অবশ্য জানে মেডিক্যালে দু’টি ইকমো যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে যে যন্ত্র চলছে না সেই খবরই অজানা। চিকিৎসক সংগঠনগুলির অভিযোগ, কোভিড আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ সরকারি চিকিৎসকরা ইকমো ( ECMO) পরিষেবা পেতে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছেন।

১৮ দিনের লড়াই শেষে শুক্রবার মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে মারা গিয়েছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ সুব্রত সোম (৬৫)। শুধু মালদহের চক্ষু বিশেষজ্ঞ নন। ইকমো-পরিষেবার জন্যই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান যাদব দত্ত এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের নিউরোসার্জন সংঘমিত্রা সরকারকেও মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য কয়েক লক্ষ টাকার খরচ এখনও পর্যন্ত কোভিড যোদ্ধা অর্থাৎ চিকিৎসাধীন সরকারি চিকিৎসকদের পরিজনদেরই দিতে হচ্ছে বলে খবর। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সে’র সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলছেন, ইকমোয় সুব্রতবাবুর চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে ৩০ লক্ষ টাকার বেশি বিল হয়েছে।

আরও পড়ুন: বাংলায় করোনা আক্রান্ত আরও এক চিকিৎসকের মৃত্যু

ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে কৃত্রিম ফুসফুসের সাহয্যে রোগীকে সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়ার নাম ইকমো। ইকমো সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার সভাপতি চিকিৎসক অর্পণ চক্রবর্তী বলেন, অক্সিজেনহীন রক্তকে দেহ থেকে বার করে কৃত্রিম ফুসফুসে (অক্সিজেনেটর) তা ঢোকানো হয়। অক্সিজেন যুক্ত এবং CO2 বিযুক্ত হওয়ার পরে শুদ্ধ রক্ত যন্ত্রের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের পরিবর্ত পাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে রক্ত শরীরে ঢোকানো হয়। কোভিড নিউমোনিয়ার কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইকমো পদ্ধতিতে চিকিৎসায় সুফল মেলার নজির রয়েছে।

সেই যন্ত্র সরকারি কোভিড হাসপাতাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নেই কেন?

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, গত দু’মাস ধরে রাজ্যের প্রথম সারির কোভিড হাসপাতালে দু’টি ইকমো যন্ত্র পড়ে রয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে পরিষেবা শুরু করা যায়নি। মেডিক্যালের এক প্রশাসক-চিকিৎসকের কথায়, “সিটিভিএস এবং অ্যানাস্থেসিয়া বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিষেবা চালু হবে। কিন্তু শুধু পরিষেবা চালু করলে হবে না। ইকমোয় থাকা রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির উপরে সর্বক্ষণ নজর রাখা প্রয়োজন। তার জন্য প্রশিক্ষিত বিশেষ দল থাকা আবশ্যক। এখন যে সংখ্যক প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছেন তা দিয়ে পরিষেবা চালু করা সম্ভব নয়।”

চিকিৎসক মহল সূত্রের খবর, নভেম্বরের ২১ তারিখ সুব্রতবাবুর করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল। তার আগে ছ’দিন ধরে জ্বর ছিল চক্ষু বিশেষজ্ঞের। করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর তাঁকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখানে দিন তিনেক চিকিৎসাধীন থাকার পরে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ‘পরামর্শ’ দেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরা। স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এএইচএসডি’র সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা। তাঁর কথায়, “জেলা হাসপাতালে সিসিইউ থাকলেও তা গুরুতর কো-মর্বিডিটিতে আক্রান্ত চিকিৎসকের প্রাণ বাঁচানোর মতো নয়। তাই ঝুঁকি আছে জেনেও সুব্রতবাবুকে অ্যাম্বুল্যান্সে কলকাতায় আনার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হ‌ই।”

আরও পড়ুন: প্রকাশিত ২০২১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ সূচি

চিকিৎসক সংগঠনগুলির বক্তব্য, জেলা থেকে একজন গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীকে কলকাতায় আনতে হবে কেন? সরকারি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত খরচে বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিতে তো কার্যত বাধ্য করা হচ্ছে! ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক রাজীব পাণ্ডে বলেন, “ইকমো পদ্ধতিতে চিকিৎসার খরচ অনেক। সরকারি চিকিৎসকদের পরিবারকে যাতে সেই টাকা খরচ করতে না হয় তা স্বাস্থ্য দফতরের দেখা উচিত।” কোভিড হাসপাতালে প্রোটোকল মেনে চিকিৎসা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য ঘটা করে প্রোটোকল মনিটরিং টিম গঠন করেছিল স্বাস্থ্য ভবন। সেই কাজে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পরিকাঠামো গত ত্রুটি চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের নজরে আনাও প্রোটোকল ম্যানেজমেন্ট টিমের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পরিদর্শন শেষে কলকাতা, জেলার হাসপাতালের এই ছবি কি স্বাস্থ্যকর্তাদের নজরে আনা হয়নি!

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ইকমো পরিষেবার অনুপস্থিতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, “ওখানে তো দু’টি ইকমো রয়েছে! আমি ব্যক্তিগত স্তরে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম।” ঘটনা হল, প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া এখনও ‘শিক্ষানবিশ’ হয়েই রয়েছে।

Next Article