অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়
মুখে স্মিত হাসি। মনোযোগ দিয়ে শুনছেন সাংবাদিকদের প্রশ্ন। তারপর উত্তর দিচ্ছেন। যাঁকে যেকোনও প্রশ্ন করা যায়। মনক্ষুণ্ণ হন না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললে এই ছবিই আমার কাছে ভেসে ওঠে।
১৯৮২-৮৩ সাল থেকে মহাকরণ বিট করছি। তখন একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্য তখন জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় নেই। কারণ, ১৯৮২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে কাশীপুরে হেরে গিয়েছেন তিনি। পাঁচ বছর পর ১৯৮৭ সালে যাদবপুর আসনে প্রার্থী হন। এবং জিতে আসেন। ১৯৮৭ থেকে প্রায় বছর দশেক রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জ্যোতি বসুর ডেপুটি এবং ২০০০ সালের নভেম্বর থেকে ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী।
১৯৮৭ সালে তিনি ফের জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় জায়গা পাওয়ার পর বিভিন্ন সময় সাংবাদিক হিসেবে তাঁর মুখোমুখি হয়েছি। তবে বলতে গেলে নয়ের দশকের শুরু থেকে বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে যোগাযোগটা বাড়ে। মহাকরণ বিট করার সূত্রেই। একবার সাংবাদিক হিসেবে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভিয়েতনাম সফরে সঙ্গী ছিলাম।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য খুব সিগারেট খেতেন। এটা প্রায় সকলেই জানেন। সেটা আমরা দেখেওছি। অনেকের দুই আঙুলে আংটি দেখি আমরা। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দুই আঙুলের মাঝে থাকত সিগারেট। কফি ও সিগারেট খেতেন খুব। দিনে কফি খেতেন ১২-১৪ কাপ। সিগারেট বোধহয় তার চেয়েও বেশি খেতেন। অনেকে তাঁকে সিগারেট খেতে বারণ করতেন। এই একটা কথা, রিপোর্টাররাও তাঁকে বলতে পারতেন। সিগারেট না খাওয়ার অনুরোধ করতেন। উনি হাসতেন। কিছু বলতেন না।
সিঙ্গুর থেকে টাটারা পাততাড়ি গোটানোর পরের একটি ঘটনা আজ খুব মনে পড়ছে। মহাকরণে আমি ও আরও জনা দুই সাংবাদিক তাঁর দফতরে গেলাম। সেদিন তাঁকে বিধ্বস্ত লাগছিল। সাধারণত, সাংবাদিকদের সামনে উনি সহজ থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু, আমাদের এই জনা তিনেকের উপস্থিতিতে ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম তাঁকে।
সিঙ্গুরে কারখানা না করতে পারার যন্ত্রণা চেপে বলেছিলেন, “সিঙ্গুর আমি করতে পারলাম না। এটা আমার দুঃখ। এটা বাংলার জন্য করতে চেয়েছিলাম। অনেক রকম বাধা এসেছিল। কিন্তু, সেসব মোকাবিলা করে বাংলার জন্য ভাল কিছু করতে চেয়েছিলাম।” সেদিন দৃশ্যতই তাঁকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। কিছুটা ভারাক্রান্ত মন। এমনভাবে তাঁকে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
১৯৯৩ সালে জ্যোতি বসুর আমলে মহাকরণ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লালবাজারে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা টানা অবস্থান-অনশন করেছেন। কিন্তু, বুদ্ধদেববাবু তাঁকে সরিয়ে দেননি। তিনি বলতেন, বিরোধী নেত্রীর অধিকার রয়েছে বিরোধিতা করার।
শেষবার বুদ্ধদেবকে দেখেছি পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে। বছর কয়েক আগে অসুস্থ বুদ্ধদেবকে দেখতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংবাদিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিলাম। ঘরের বাইরে থেকে দেখেছিলাম। স্মিত হাসির বুদ্ধদেবের সঙ্গে সেদিনের ছবিটা মেলাতে পারিনি। শারীরিক অসুস্থতায় শরীর অনেকটাই ভেঙেছে।
আজ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের পর মহাকরণের সেদিনের ছবিটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিধ্বস্ত। ভারাক্রান্ত। যিনি জনা তিনেক সাংবাদিককে কারখানা না-করতে পারার যন্ত্রণার কথা বলছেন। যিনি বলছেন, ‘বাংলার জন্য ভাল কিছু করতে চেয়েছিলাম।’
(লেখক ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাংবাদিক)
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)