বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলজীবন মূলত তিন ভাগে ভাগ করা। প্রাথমিক স্তর (প্রাইমারি), মাধ্যমিক স্তর (সেকেন্ডারি) ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর (হায়ার সেকেন্ডারি)। চতুর্থ শ্রেণি বা ক্লাস ফোরের পর থেকেই অভিভাবকদের চিন্তা শুরু হয়ে যায়, কোন হাইস্কুলে ভর্তি করাবেন। প্রাইমারি যদি একজন শিক্ষার্থীর জন্য ভিত হয়, মাধ্যমিক স্তর তাহলে ভবিষ্যতের শুরু। তাই স্কুল বেছে নেওয়ার সময় সবদিক বিচার করেন অভিভাবকরা। তবে এবার শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসছে, তাতে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার সময় বাবা-মায়ের বেশি চিন্তা থাকবে না।
রাজ্যের অনেক প্রাথমিক স্কুলেই রয়েছে পঞ্চম শ্রেণি পড়ার সুযোগ। তবে এবার ধাপে ধাপে সেই সংখ্যাটা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে ২৩৩৫টি প্রাথমিক স্কুলে ক্লাস ফাইভ চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে হাইস্কুলগুলিতেও রয়েছে পঞ্চম শ্রেণি। প্রশ্ন হল, দুই স্কুলে একই রকম ব্যবস্থা কেন? প্রাথমিক স্কুলে অধিক শ্রেণি যুক্ত করার কারণই বা কী? প্রাথমিকে ক্লাস বাড়িয়ে কী লাভ?
রাজ্যের কতগুলি প্রাথমিক স্কুলে ক্লাস ফাইভ থাকছে?
রাজ্যে মোট প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৩৭৫। ২০১৮ সালে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পঞ্চম শ্রেণি যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কয়েক হাজার প্রাথমিক স্কুলে ইতিমধ্যে পঞ্চম শ্রেণি যুক্ত করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ১৭ হাজার স্কুলে চালু হয়েছিল এই নিয়ম। বর্তমানে তার সঙ্গেই যুক্ত হল ২৩৩৫টি স্কুল। অর্থাৎ ১৯ হাজারের বেশি প্রাথমিক স্কুলে চালু হয়ে গেল পঞ্চম শ্রেণি।
কেন প্রাইমারিতে যুক্ত হচ্ছে ক্লাস ফাইভ?
বহু বছর ধরে প্রাথমিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করারই প্রথা রয়েছে। তাহলে হঠাৎ ক্লাস বাড়ানোর অর্থ কী?
আসলে ২০০৯ সালে পাশ হওয়া রাইট অব চিল্ড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কম্পালসারি এডুকেশন আইনে (Right of Children to Free and Compulsory Education Act, 2009) এই নিয়ম চালু করার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই আইন বাংলার স্কুলগুলিতে ধাপে ধাপে কার্যকর করা হত।
ওই আইনে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একটি ধাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকবেন, বছরে কতদিন ক্লাস করানো যাবে, এই বিষয়গুলি উল্লেখ করা আছে। সেই আইনেই এই সুপারিশ ছিল। কারণ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চতুর্থ শ্রেণি পাশ করা একজন পড়ুয়া হাইস্কুলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না।
কারণ এক: চতুর্থ শ্রেণি পাশ করা একজন শিশুর মানসিক বিকাশ ততটাও হয় না, যাতে হাইস্কুলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে সে।
কারণ দুই: হাইস্কুলে অনেক বেশি বিষয় পড়ানো হয়, বেশি ক্লাস থাকে। সেখানে পড়ুয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি। প্রাথমিক স্কুলে
অপেক্ষাকৃত পড়ুয়ার সংখ্যা কম। ফলে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের দিকে বেশি নজর দিতে পারবেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
কারণ তিন: বর্তমানে রাজ্যে হাইস্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা অনেক কম। সেই তুলনায় প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা কিছুটা বেশি। তাই প্রাথমিক স্কুলের ওপর ক্লাসের চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি মেনে দেশের প্রায় সব রাজ্যেই প্রাথমিকে পঞ্চম শ্রেণি যুক্ত করা হয়েছে। বাকি ছিল এক মাত্র পশ্চিমবঙ্গই। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আমল থেকেই বাংলায় চালু হয় এ নীতি।
কোন ফাইভে পড়বে পড়ুয়ারা?
এই নীতি চালু হওয়ার আগে সব সাধারণত পড়ুয়ারা নিকটবর্তী হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করত। কোথাও কোথাও কোনও শর্ত ছাড়াই ভর্তি নেওয়া হত, কোথাও স্কুলের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া হয়। আবার কোথাও প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি করানো হয়। তবে প্রাথমিক স্কুল ও হাই স্কুল উভয় ক্ষেত্রেই পঞ্চম শ্রেণি থাকলে বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারেন পডুয়ারা।
শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, একটি এলাকায় যদি সব প্রাথমিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি যুক্ত হয়ে যায়, তাহলে হাইস্কুল থেকে একে একে ক্লাস ফাইভ তুলে দেওয়া হবে। তবে আপাতত দু জায়গাতেই থাকছে ক্লাস ফাইভ। যদি কোনও পডুয়া প্রাথমিকের ক্লাস ফাইভে পড়ে, তাহলে পরবর্তী সময়ে হাইস্কুলের ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে কোনও অসুবিধা থাকবে না।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকছে, সংশ্লিষ্ট হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়ারা স্বাভাবিক নিয়মেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে, তাহলে প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়ারাও ভর্তি হতে গেলে কি নতুন করে চাপ বাড়বে না হাইস্কুলে? তব হাইস্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি উঠে গেলে অবশ্য সেই সমস্যা থাকবে না।
সূত্রের খবর, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের কথা ভেবেই এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে গেলে ডিএলএড ট্রেনিং থাকতে হয়, শিশুদের মানসিক বিকাশ বুঝতে গেলে যা জানতে হয়, তা ডিএলএড-এ শেখানে হয়। বিএড-এর ক্ষেত্রে সবসময় সেই ট্রেনিং থাকে না। সে কথা ভেবেই পঞ্চম শ্রেণিকে প্রাথমিকের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে শেষ বার উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। ২০১৪ সালে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হলেও দুর্নীতির কারণে প্রায় ১০ বছর আটকে সেই নিয়োগ। ফলে হাইস্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। এদিকে, প্রাথমিক স্কুলগুলির পরিকাঠামো নিয়েও রয়েছে অনেক অভিযোগ। ফলে, প্রাথমিকে ক্লাস ফাইভ জুড়লেও কতটা লাভ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।