অনশনে মেওয়া ফলে? গান্ধীজি, শর্মিলা থেকে মমতা, কী বলছে ইতিহাস!

Hunger Strike: আজ যখন অনশনকারীদের নিশানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের সরকার, তখন বারবার ঘুরেফিরে আসছে মমতার অনশনের কথা। আজ আন্দোলন নিয়ে রাজ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হলেও মমতা একসময় পথে নেমে আন্দোলন কীভাবে করতে হয়, তা দেখিয়েছিলেন মমতাই। সিঙ্গুরে কৃষকদের জমিতে কারখানা তৈরির প্রতিবাদে সুর চড়িয়েছিলেন মমতা।

অনশনে মেওয়া ফলে? গান্ধীজি, শর্মিলা থেকে মমতা, কী বলছে ইতিহাস!
Follow Us:
| Updated on: Oct 21, 2024 | 5:25 PM

দাবি ছিনিয়ে আনতে যখন গলার জোরও কম হয়ে যায়, মাইলের পর মাইল হেঁটেও যখন কেউ কথা শোনে না, তখন ‘মৃত্যু’ই হয়ে ওঠে একমাত্র ‘হাতিয়ার’। মুখে খাবার না তুলে দিনের পর দিন বসে থাকা। আমরণ অনশন। নেহাতই রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার? নাকি দাবি হাসিল করে আনার এর থেকে শক্তিশালী উপায় আর নেই?

ইতিহাস বলে, যীশুখ্রিস্টের জন্মের আগে অনশন আন্দোলন নাকি প্রথম শুরু হয়েছিল আয়ারল্যান্ডে। সে দেশের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সেলাশ’ (Cealachan)। বিচার পেতে অভিযুক্তের বাড়ির দরজায় খালি পেটে বসে থাকতেন সে দেশের মানুষ। আসলে ‘আতিথেয়তা’ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে বাড়ির দরজায় এসে না খেয়ে বসে থাকাটাই ছিল সেই সময় বাড়ির মালিকের সবথেকে বড় অপমান। কালে কালে সেই অনশন অনেক বৃহত্তর পরিধি ছুঁয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতার ৭০ বছর পর, আজও শাসককে টলাতে রাজপথে চলে অনশন। শাসকের কি কিছু যায় আসে?

১০ জনের মৃত্যুতেও টলেননি মার্গারেট থ্যাচারের সরকার

যারা আমরণ অনশনের জন্ম দিয়েছিল, সেই দেশেই রয়েছে কঠিন অনশনের উদাহরণ। ১০ জন জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছিল সেই অনশনে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির যে সদস্যরা জেলে বন্দি ছিলেন, তাঁদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে ‘স্পেশাল স্টেটাস’ দেওয়া হত একসময়। পরবর্তীতে সেই স্টেটাস তুলে নেয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে সেই স্টেটাস ফেরাতে চলে লড়াই। প্রথমে নিজেদের নগ্ন করে রেখে চলে প্রতিবাদ, জেলের কুঠুরিকেই শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করে চলে প্রতিবাদ। কিছুতেই কিছু হয়নি! শেষে শুরু হয় অনশন।

১৯৮১ সালের মার্চ মাসে অনশন শুরু করেন সেই জেলবন্দিরা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের স্পষ্ট অবস্থান ছিল, কোনও অবস্থাতেই ঝুঁকবেন না। ৬৬ দিন অনশন চালানোর পর মৃত্যু হয় সেই আন্দোলনের মুখ ববি স্যান্ডের। সেই বছরের অগস্টের মধ্যে এভাবেই মৃত্যু হয় ১০ বন্দির। তাতেও টলেনি সরকার। এরপর অক্টোবরে আন্দোলনরত বন্দিদের পরিবার সরব হয়, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

১০ জনের মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত হার মানে সরকার। স্টেটাস ফিরিয়ে দিয়েছিল তাদের। ক্রমে ক্রমে রাজনৈতিক বন্দি হওয়ার সুবিধা পেতে শুরু করেন তাঁরা।

বারবার অনশনে বসেছেন গান্ধীজি

ভারতে অনশন আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিলেন যিনি, তিনি মহাত্মা গান্ধী। তিনি অনশনকে ‘হাতিয়ার’ বলেই মনে করতেন। ব্রিটিশ আমলে ২০ বার এই আন্দোলনের পথ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালে একটানা ২১ দিন আন্দোলন করেছিলেন তিনি। একবার নয়, পরপর তিন বার।

ব্রিটিশ শাসন শেষ করার জন্যই ছিল তাঁর অনশন। প্রথমে ১৯৪৩ সালের অনশনে কোনও ইতিবাচক ফল আসেনি। তবে ১৯৩৩ সালে হরিজনদের অধিকারের জন্য যখন গান্ধীজি লড়াই করেছিলেন, তখন সাফল্য পান তিনি।

শরীর ভেঙে যায় শর্মিলার, জারি থাকে AFSPA

ভারতে গান্ধীজি বা ভগত সিং-এর মতো ব্যক্তিত্বরা অনশন আন্দোলন করেছেন। তবে ভারতের অনশনের ইতিহাসে লেখা থাকবে শর্মিলা চানুর নাম।

২০০০ সালের নভেম্বরে একটি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ১০ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল শর্মিলাকে। আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট বা AFSPA-র জোরে কেন যেখানে সেখানে গুলি চালাতে পারবে সেনাবাহিনী? এই প্রশ্ন তুলে কাউকে সঙ্গে না নিয়ে একা অনশনে বসেছিলেন শর্মিলা। তিনি চেয়েছিলেন AFSPA তুলে নিতে হবে।

পুলিশ গ্রেফতার করেছে, জেলে বন্দি করেছে, কোনও কিছুতেই নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি শর্মিলা। বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির কাছে, মণিপুরের সাধারণ পরিবারের মেয়ে শর্মিলা ছুটে গিয়েছেন দিল্লিতে। তিনি বলতেন, ‘যেদিন AFSPA উঠে যাবে, আমি আমার মায়ের হাতে ভাত খাব।’ ১৬ বছর কেটেছে এভাবেই। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে নাকে টিউব লাগিয়ে জোর করে শরীরে প্রবেশ করানো হত খাবার। এত দীর্ঘ অনশন গোটা বিশ্ব দেখেনি কখনও। কিন্তু ফলাফল?

না, শর্মিলার দীর্ঘতম আন্দোলনের পরও AFSPA ওঠেনি। রাজনীতির ময়দানে নেমে ২০১৬ সালে অনশন ভাঙেন শর্মিলা। তবে সরাসরি তাঁর দাবি মানা না হলেও পরবর্তীতে AFSPA আংশিকভাবে উঠতে শুরু করে। আর সরকারের সেই পদক্ষেপকেই আন্দোলনের সাফল্য বলে মনে করেন তিনি। যদিও পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায়, আবারও মণিপুরে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে AFSPA-র। শর্মিলার ১৬ বছরের লড়াইয়ের ফল কি আদৌ দেখবে মণিপুর, নাকি নেহাতই একটা ‘রেকর্ড’ হয়ে থেকে যাবে?

TATA-কে টলাতে পেরেছিল মমতার সেই ২৬ দিন?

আজ যখন অনশনকারীদের নিশানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের সরকার, তখন বারবার ঘুরেফিরে আসছে মমতার অনশনের কথা। আজ আন্দোলন নিয়ে রাজ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হলেও মমতা একসময় পথে নেমে আন্দোলন কীভাবে করতে হয়, তা দেখিয়েছিলেন মমতাই। সিঙ্গুরে কৃষকদের জমিতে কারখানা তৈরির প্রতিবাদে সুর চড়িয়েছিলেন মমতা। ক্ষমতায় থাকা বামেদের ওপর চাপ তৈরি করতে একটানা ২৬ দিন অনশনে বসেছিলেন তিনি। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে সেই ২৬ দিন, তবে তাঁর অনশনে কারখানা বন্ধ হয়নি সে দিন।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের তৎপরতায় মমতার কাছে চিঠি পৌঁছনোর পর অনশন তুলে নেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী। সেটা ছিল ২০০৬ সাল। তার প্রায় ২ বছর পর ২০০৮ সালে বাংলা থেকে সরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে টাটা। মমতা আন্দোলনের সাফল্যের কথা বললেও, অনশন আন্দোলনের সাফল্য বলা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

শহর কলকাতার রাস্তায় আবারও শুরু হয়েছে অনশন। অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবিতে না খেয়ে বসে আছেন একদল তরুণ চিকিৎসক। শরীরে বাড়ছে কিটোন বডির মাত্রা। অনশন তুলে নেওয়ার অনুরোধ করছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে অধিকার কি ফিরে পাবে তারা, নাকি এই আন্দোলনও নিছক রয়ে যাবে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায়?