ব্যানার্জি বনাম ব্যানার্জি: রাজীব তো ইঙ্গিত দিয়েই গিয়েছিলেন, কল্যাণ ধরতে পারেননি

Nov 01, 2021 | 3:44 PM

এতক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের পায়েই বল ছিল। বলে বলে রাজীবকে দশ গোল দিয়েছেন তিনি। প্রায় ৪০ হাজার ভোটে নিজের কেন্দ্রে গোহারা হারেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়

ব্যানার্জি বনাম ব্যানার্জি: রাজীব তো ইঙ্গিত দিয়েই গিয়েছিলেন, কল্যাণ ধরতে পারেননি
ব্যানার্জি বনাম ব্যানার্জি। গ্রাফিক্স- অভিক দেবনাথ

Follow Us

দৃশ্য এক। জানুয়ারির মাঝামাঝি। চওড়া শীতের আমেজ। ‘দাদার অনুগামীরা’ অলিগলিতে পোস্টার সাঁটিয়েছে, ‘নয়নের মণি রাজীব দা’। কোথাও, ‘কাজের মানুষ, কাছের মানুষ’। জল্পনার পারদ চড়তে থাকে শীতের দুপুরে। এরপর এক শনিবারের বারবেলায় ফেসবুক লাইভ করে সেই জল্পনায় আরও ঘৃতাহুতি দেন ডোমজুড়ের তৎকালীন বিধায়ক। বলেন, “দলের কর্মীরা সম্মান চান। আমার নেত্রীও সে কথা বলেন। কিন্তু দেখা যায়, সে কথা রাখা হয় না।”

তাঁর ‘অভিমান’ এভাবে উথলে ওঠায় আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের প্রার্থীকে রাজীবই হারিয়েছিলেন। সে দিন কোথায় ছিল কর্মীদের সম্মান? তবে এই অভিযোগটুকু করেই সে দিন ক্ষান্ত ছিলেন ‘ঠোঁটকাটা’ কল্যাণ।

দৃশ্য দুই। ২২ শে জানুয়ারি। তখনও দল ছাড়েননি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজভবনে গিয়ে শুধুমাত্র রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে আসেন। এরপর বাইরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। টেলিভিশনে ব্রেকিং দেখে তিনি নাকি জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর সেচ দফতর হাত বদল হয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন অপমানিত হয়েছেন বলে তাঁর দাবি। এ সব বলতে বলতেই রাজভবনের সামনে বাচ্চা ছেলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন দু’বারের বিধায়ক।

এবারও প্রতিক্রিয়া আসে ‘ঠোঁটকাটা’ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তবে, ভাযা আরও তীক্ষ্ণ। কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আইনজীবী-সাংসদ বলেন, সুর-বেসুর-অসুর জানি না। যদি অন্য দলে যায় এবং ডোমজুড়ে দাঁড়ায়, দেখিয়ে দেব। তখনও পর্যন্ত ওইটুকুই তাঁর মাপা প্রত্যাঘাত ছিল রাজীবের বিরুদ্ধে। বাকিটা উগড়ে দিয়েছিলেন কাঁথির ‘মেজবাবুর’ উদ্দেশে। কারণ, তখনই তৃণমূল ছেড়ে সদ্য বিজেপি-তে যোগদান করেন শুভেন্দু অধিকারী।

দৃশ্য তিন। ২৯ জানুয়ারি। এবার বিধায়ক পদ ছাড়লেন বিধানসভায় গিয়ে। ফ্রেমে বাঁধানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাউস ছবি বগলদাবা করে সে দিন বিধানসভা ছেড়েছিলেন রাজীব। মুখে বারংবার তৃণমূল সুপ্রিমোকে নিয়ে আবেগঘন স্তুতি। কারোর মনে হতেই পারে, কোনও কর্মী বেশি প্রমোশন নিয়ে এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় যাচ্ছেন, আজ তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা। সে দিন বলেছিলেন, “দলনেত্রী মায়ের মতো। আমার দ্বিতীয় মা। মাথার পিছনে সবসময় ওঁর ছবি থাকত। আগামী দিনও থাকবে।”

আজ অনেকে বলছেন, ফিরে আসার পথ রাজীব যে সেদিনই তৈরি করে গিয়েছিলেন, সে কথা বুঝতে পারেননি দুঁদে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দৃঢ়তার সঙ্গে আবারও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তূণের শেষ তিরটাও নিক্ষেপ করেন কল্যাণ। বলেন, “ভদ্রলোকের রক্ত থাকলে ডোমজুড় থেকে দাঁড়ান। এমন হারান হারাব, দু’বছর ঘুমাতে পারবেন না।”

দৃশ্য চার। চার্টার্ড ফ্লাইট। বিমানে ওঠার আগে ‘ঐতিহাসিক’ ছবি। বৈশাখী ডালমিয়া, প্রবীর ঘোষাল, রথীন চক্রবর্তী, পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে মধ্যমণি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে গিয়ে অমিত শাহের হাত থেকে গেরুয়া পতাকা তুলে নেন। এরপর ডুমুরজলা মাঠে বিজেপি নেতা হিসাবে প্রথম সভা। ‘চলুন পাল্টাই’ স্লোগান তুলেছিলেন সেদিন। তৃণমূলের ‘চুপচাপ, ফুলে ছাপ’ স্লোগান পাল্টে রাজীব বললেন, “চুপচাপ, বিজেপিতে ছাপ।”

তবে, চুপ থাকেননি কল্যাণও। আবারও চ্যালেঞ্জ, বুকের পাটা থাকলে নিজের কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে দাঁড়াক। মুখ্যমন্ত্রীকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করার কথা বলছে, অন্যদিকে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। এ সব চক্রান্ত। ওঁর কান্না পুরোটাই নাটক।

(এতক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের পায়েই বল ছিল। বলে বলে রাজীবকে দশ গোল দিয়েছেন তিনি। প্রায় ৪০ হাজার ভোটে নিজের কেন্দ্রে গোহারা হারেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ব্যক্তিই গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় এক লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছিলেন। অর্থাৎ কল্যাণের প্রতিটি কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর…)

দৃশ্য পাঁচ। তৃণমূলের বিপুল জয় আসতেই কয়েক দিনের মধ্যে উল্টো স্রোত বইতে থাকে বঙ্গ রাজনীতিতে। যে স্রোত বেয়ে গেরুয়া সৈকতে যাঁরা ভিড় জমিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ফিরতি স্রোতে একে একে বাড়ি ফেরেন। রাজীবও যে ফিরছেন, অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন রাজনীতির কারবারিরা। জুন মাসে মুকুল রায় সপুত্র তৃণমূলে ফেরেন। সে সময়ই তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের সঙ্গে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করেন রাজীব। দুই দুয়ে চার। দলের ফেরা শুধু কি সময়ের অপেক্ষা!

এমন জল্পনা উঠতেই ফের কল্যাণের কণ্ঠে অগ্ন্যুৎপাত। কুণালকেও একহাত নিয়ে তাঁর কটাক্ষ, “ওঁদেরই শুধু বুদ্ধি আছে। আমাদের নেই? প্রমাণ করে দিয়েছি রাজীব কেউ না। ওঁর ভ্যালু জিরো। মমতা তো বলেইছেন, গদ্দারদের নেওয়া হবে না। শেষ পর্যন্ত মমতাদি এবং উচ্চ নেতৃত্ব ঠিক করবেন। মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে অনেক বাজে কথা বলেছে, তার ভিডিয়োও আছে।”

এবার এখানেই ক্ষান্ত হননি কল্যাণ। গলা সপ্তমে তুলে আরও বলেন, কুণালের সঙ্গে দেখা করেছে বলে কি গঙ্গাজলে শুদ্ধ হয়ে গেলেন? আমাদের কর্মীদের উপর কম অত্যাচার করেননি, কেন্দ্রীয়বাহিনী দিয়ে তাড়া করিয়েছেন। ‘দাঙ্গা’ লাগানোর অভিযোগও তোলেন কল্যাণ।

শেষ দৃশ্য। ৩১ অক্টোবর। ত্রিপুরায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম রাজনৈতিক সভা। সেই সভা মঞ্চে অভিষেকের হাত থেকে দলের পতাকা তুলে নিলেন ‘লজ্জিত’ রাজীব। বললেন, “অভিষেক আমার নেতা। উনি যা দায়িত্ব দেবেন, মাথায় তুলে নেব।” কার্যত আত্মসমর্পণ করলেন রাজীব।

এ দিন আর সে ভাবে সুর চড়ালেন না কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চ্যালেঞ্জও ছুড়লেন না। এমন হারাব, দু’বছর ঘুমাবেন না- এমন সংলাপও আজ আওড়ালেন না। আজ কাকেই বা চ্যালেঞ্জ ছুড়বেন! কাকেই বা হারাবেন! বরং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার আশ্রয় নিয়ে বললেন, কেউ কথা রাখেনি…সবাইকে মেনে চলতে হবে। আমাকেও মেনে চলতে হবে।

ধীরে ধীরে আলো নিভে আসে। পতন হয় যবনিকার। নিঃশব্দে হাততালি পড়ে জনগণের।

আরও পড়ুন- Rajib Banerjee: ‘কাকে দালাল বলছেন, তিনি অন্য কোনও দলের দালাল নন তো?’

Next Article