Kolkata sinking: সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে কলকাতা, আমরা কি বসেই থাকব?

Kolkata is sinking under rising sea water: গুজরাট সরকার দ্বারকায় ডুবোজাহাজের মাধ্যমে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। অদূর ভবিষ্যতে কি আমাদের শহর কলকাতারও একই পরিণতি হতে পারে? ডুবো জাহাজে করে দেখতে হবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ কিংবা ফোর্ট উইলিয়াম?

Kolkata sinking: সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে কলকাতা, আমরা কি বসেই থাকব?
একদিন এভাবেই দেখতে হতে পারে কলকাতাকে (প্রতীকী ছবি, অলঙ্করণ - শুভ্রনীল)Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Jun 26, 2024 | 9:48 AM

কলকাতা: কোমরে ময়ূরের পালক গুঁজে স্কুবা ডাইভিংয়ের পোশাক পরে সমুদ্রের গহীণে ডুব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উদ্দেশ্য ছিল, জলের তলায় তলিয়ে যাওয়া দ্বারকা শহরের অবশেষের কাছাকাছি গিয়ে ভগবান কৃষ্ণের উপাসনা করা। দ্বারকা, হিন্দুদের জন্য একটি অত্যন্ত পবিত্র পৌরাণিক শহর। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণই। কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দ্বারকাকে গ্রাস করেছিল সমুদ্র। এটা শুধু একটি পৌরাণিক কাহিনি নয়। বর্তমানে যেখানে দ্বারকা শহরটি দাঁড়িয়ে আছে, তার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের তলদেশে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনও খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। পাওয়া গিয়েছে নৌকো বাঁধার আংটা। যা থেকে মনে করা হয়, কোনও এক সময় দ্বারকা ছিল ভারতের দ্বার, এক সমুদ্র বন্দর। সমুদ্রের নীচে প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর, গুজরাট সরকার এখন ভাবছে সেখানে ডুবাজাহাজের মাধ্যমে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার কথা। অদূর ভবিষ্যতে কি আমাদের শহর কলকাতারও একই পরিণতি হতে পারে? ডুবো জাহাজে করে দেখতে হবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ কিংবা ফোর্ট উইলিয়াম?

ভাবছেন মিছিমিছি ভয় দেখানো হচ্ছে? বিশ্ব উষ্ণায়ন নামে একটা বস্তুর জন্য সমুদ্রের জলের উচ্চতা যে বাড়ছে, আজ তা সবাই জানে। তবে তা কলকাতাকে ডুবিয়ে দেবে, এটা এখনও অধিকাংশ মানুষের কাছেই বাস্তব বলে মনে হয় না। কিন্তু, সমুদ্র-রাক্ষসকে রোজ চাক্ষুস করছেন সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপের বাসিন্দারা। অবশ্য ক’জন গ্রামবাসীই বা এখনও টিকে আছেন গ্রামে? গোটা দ্বীপটাই প্রতিদিন একটু একটু করে ক্রমে জলের তলায় চলে যাচ্ছে। দ্বীপের স্কুল, বহু ঘরবাড়ি ইতিমধ্যেই জলের নিচে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার মুকুলের কথা মনে আছে? পূর্বজন্মের কথা মনে করে করে সে বলত, ওইখানে ওর বাড়ি ছিল। ওই পাশে আমাদের বাড়ি…। ঘোড়ামারা দ্বীপের বাসিন্দাদেরও অবস্থা অনেকটা মুকুলের মতোই। গ্রামের হাসিখুশি দিনগুলো যেন তাদের কাছে পূর্বজন্মের ঘটনা। তাঁরাও দেখান, ওইখানে আমাদের স্কুল ছিল। ওইখানে অমুকের বাড়ি। দ্বীপের অধিকাংশ বাসিন্দারই পরিচয় এখন, ‘ক্লাইমেট ইমিগ্র্যান্ট’ বা ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে যাদের হারাতে হয়েছে ভিটে-মাটি, বিশ্বজোড়া সেই সব মানুষদের দলে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। ঘরবাড়ি হারিয়ে বেশিরভাগ গ্রামবাসী দ্বীপ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

এভাবেই একটু একটু করে জলের তলায় চলে যাচ্ছে ঘোড়ামারা দ্বীপ

কলকাতা থেকে ঘোড়ামারা দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। গাড়ি-লঞ্চ যোগে গেলে সময় লাগে মেরেকেটে ৪ ঘণ্টা। কলকাতা থেকে ৪ ঘণ্টা দূরের একটা দ্বীপের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে কলকাতার বিপদও খুব বেশি দূরে নয়, তা আঁচ করাই যায়। এই বিপদের আভাস পাওয়া গিয়েছে বিশ্বব্যাপী বেশ কয়েকটি গবেষণাতেও। বিশ্ব উষ্ণায়ন – শব্দটা খুব একটা নতুন নয়। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই বিপদটা আঁচ করতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ধরা পড়েছিল দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে হিমবাহগুলি। মেরু অঞ্চলে যে বরফের ক্যাপ রয়েছে, ক্রমে কমছে তার পরিমাণ। তাঁরা সতর্ক করেছিলেন, এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলির টনক নড়তে নড়তে ১৯৭৯ সাল এসে গিয়েছিল। ওই বছরের ১২ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বসেছিল প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। যাইহোক, সেই সময় বিজ্ঞানীরা হিমবাহগুলি কী হারে গলছে তার একটা হিসেব কষেছিলেন। আগামী দিনে কত হারে গলবে, তারও একটা অনুমান করেছিলেন। কিন্তু, তারপর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আরও দ্রুত হারে বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হিমবাহগুলি গলে যাওয়ার হার।

২০১৯ সালে ‘স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট’-এ, হিমবাহ বিশেষজ্ঞ মৌরি পেল্টো জানিয়েছিলেন, গত শতাব্দীর আশির দশকে প্রতি বছর গড়ে ১৭১ মিলিমিটার করে কমছিল হিমবাহগুলি। নয়ের দশকে হিমবাহ কমে যাওয়ার হার বেড়ে গিয়ে হয়েছিল প্রতি বছর গড়ে ৪৬০ মিলিমিটার। নয়া শতাব্দীর শূন্য দশকে হিমবাহগুলি কমছিল প্রতি বছর গড়ে ৫০০ ১.৬ ফুট করে। আর তার পরের দশকে হিমবাহ কমার হার বেড়ে হয়েছে প্রতি বছরে ৮৮৯ মিলিমিটার। নেপালের ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট’ আবার হিমালয়ের হিমবাহগুলি নিয়ে আরও ভয়ঙ্কর একটা রিপোর্ট দিয়েছে। তারা বলছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে যে হারে হিমবাহ গলেছে, তার থেকে বর্তমান দশকে ৬৫ শতাংশ দ্রুত হারে হিমবাহ উধাও হয়ে যাচ্ছে হিমালয় থেকে। আর এই হিমবাহ গলে যাওয়ার হার বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমুদ্র-পৃষ্ঠের উচ্চতাও।

দ্রুত গলে যাচ্ছে বরফের চাদর, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা

নাসার ‘সি লেভেল চেঞ্চ অবজারভেশন ফ্রম স্পেস’-এর কাছে গত প্রায় ৩০ বছরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির রেকর্ড রয়েছে। দেখা গিয়েছে ১৯৯৩ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২.৫ মিলিমিটার করে। বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে ৩.৪ মিলিমিটার করে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ২০২১ সালে, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ২০২১: দ্য ফিজিকাল সায়েন্স বেসিস’ নামে এক আন্তঃসরকারি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ১৯৭০ সাল থেকে প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২.৩ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৩,০০০ বছরে এত দ্রুত হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে দেখা যায়নি। ২০১৩ থেকে ২০২২-র মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বেড়ে হয় প্রতি বছর ৪.৬২ মিলিমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পিছনে হিমবাহ এবং মেরু অঞ্চলের বরফের চাদর গলে যাওয়া যদি ৪৪ শতাংশ দায়ী হয়ে থাকে, তাহলে ৪২ শতাংশ দায়ী জলের তাপীয় প্রসারণ।

যাইহোক, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই হারে বাড়তে থাকায়, দ্রুত বদলে যেতে পারে গোটা পৃথিবীর মানচিত্রই। ২০২১ সালে, এরকমই এক মানচিত্র তৈরি করেছিল ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রাল’ সংস্থা। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর তথ্য ব্যবহার করে ২০৩০ সালের পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি করেছিল তারা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর উপকূলীয় এলাকার বহু শহরই জলের তলায় তলিয়ে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছিল তারা। তার মধ্যে ছিল কলকাতা এবং সুন্দরবন-সহ একটা বড় অংশ। অর্থাৎ, তাদের পূর্বাভাস ২০৩০ সালের মধ্যেই এই এলাকা জলের নীচে চলে যাবে। আর তার আগে, কলকাতা শহর সাক্ষী হতে পারে একের পর এক বন্যার। ২০৩০ সাল কিন্তু আর মাত্র ৬ বছর দূরে।

ক্লাইমেট সেন্ট্রালের মানচিত্র, ডুবে যাবে লাল এলাকাগুলি

আইআইটি খড়্গপুরের বিজ্ঞানীরাও এই ধরনের এক সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছেন। ২০১৭ সালে, সমুদ্র-স্তরের বৃদ্ধির উপর একটি সমীক্ষা করেছিল আইআইটি খড়্গপুরের ‘ওশান এনার্জি অ্যান্ড নাভাল আর্কিটেকচার’ বিভাগ। সমীক্ষাটির নাম ছিল, ‘অ্যাসেসমেন্ট অব ক্লাইমেটোলজিক্যাল ট্রেন্ড অব সি লেভেল ওভার দ্য ইন্ডিয়ান কোস্ট’। অধ্যাপক প্রসাদ কুমার ভাস্করনের নেতৃত্বে হওয়া সেই গবেষণায় জানা গিয়েছিল, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ১.৩৫ মিলিমিটার করে বাড়ছে। আর আরব সাগরের উচ্চতা বাড়ছে ০.৩৭ মিলিমিটার করে। অর্থাৎ, পশ্চিম উপকূলের আগে পূর্ব উপকূলের নিচু এলাকাগুলি ডুবে যাবে। এছাড়া, তাদের সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছিল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে, পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব উপকূলের আরও বিস্তৃত অঞ্চল প্রভাবিত হবে।

ফলে, কলকাতার ঝুঁকিটা অনেক বেশি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব ওশানোগ্রাফিক স্টাডিজ’-এর এক সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১২ মিলিমিটার বেড়েছে। বিশ্বব্যাঙ্কের ২০১২ সালের প্রতিবেদনে এই তথ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯-এ, কেন্দ্রও সংসদে এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র পেশ করেছিল। সেই গবেষণাপত্রে উঠে এসেছিল এক ভয় ধরানো তথ্য। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সবথেকে বেশি বেড়েছে কোথায় জানেন? কলকাতা থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ডায়মন্ড হারবারে। ১৯৪৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ডায়মন্ড হারবারের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ৫ মিলিমিটার।

কাজেই আজ হোক, কিংবা কাল – কলকাতার ডুবে যাওয়া প্রায় অনিবার্য। কলকাতার মতোই নীচু এলাকায় অবস্থিত থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক। কলকাতার ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সতর্ক করেছে যেমন একাধিক গবেষণাপত্র, ব্যাঙ্ককের ক্ষেত্রেও তাই। বিভিন্ন সংস্থাই জানিয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে অদূর ভবিষ্যতেই ডুবে যাবে ব্যাঙ্কক। দ্বারকার মতোই হয়ত জলের নীচে গিয়ে দেখতে হবে এই ঝকঝকে অত্যাধুনিক শহরকে। এই অবস্থায় দেশের রাজধানী ব্যাঙ্কক থেকে অন্যত্র সরানোর চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছে থাইল্যান্ড। সেখানকার জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল, পাভিচ কেসাভাওং জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ব্যাঙ্ককের ডুবে যাওয়া আটকানো যাবে বলে, তিনি মনে করেন না। বর্তমানে পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাঙ্কক ডুববেই। এই অবস্থায়, নেদারল্যান্ডসে যেমন ডাইক বা বাঁধ আছে, উপকূল বরাবর সেই রকম বাঁধ তৈরি করতে চলেছে থাই সরকার। এছাড়া আরও কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে রাজধানী সরানোর কথা ভাবছে। ব্যাংকক, দেশের রাজধানী হিসেবে থেকে যাবে। আর অন্যত্র এক নতুন ব্যবসায়িক বা অর্থনৈতিক রাজধানী তৈরির কথা ভাবছে তারা। ইন্দোনেশিয়াও একই কারণে জাকার্তা থেকে রাজধানী সরাচ্ছে নুসান্তারা-য়। কলকাতায় এমন কোনও পদক্ষেপ দেখা গিয়েছে কি? নিদেন পক্ষে আলোচনা?