Sonagachi: সোনাগাছির অ, আ, ক, খ…

Sonagachi Education: পথশিশু, আদিবাসী থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে কাজ করা সন্দীপবাবু বুঝেছিলেন, বয়স ও অভিজ্ঞতায় পরিণত এই মহিলাদের ছোট শিশুদের মতো শিক্ষা দিতে গেলে তাদের লেখাপড়ার প্রতি কোনও আগ্রহ আসবে না। বরং রোজনামচায় যে শব্দগুলি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়, সেগুলি লেখা, অক্ষর চেনার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি থাকবে।

Sonagachi: সোনাগাছির অ, আ, ক, খ...
প্রতীকী ছবি।Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Jun 29, 2024 | 1:38 PM

‘অ-অজগর আসছে তেড়ে/ আ- আমটি খাব পেড়ে/ ই-ইঁদুরছানা ভয়ে মরে/ ঈ-ঈগলপাখি…’ মুখে বুলি ফোটার পর শিশুদের এভাবেই ছড়ার সঙ্গে শিক্ষার প্রথম পাঠ দেওয়া হয়। এটাই সাধারণ শিক্ষাদানের পদ্ধতি। আমরা সকলেই এভাবে শিক্ষার প্রথম পাঠ নিয়েছি। প্রথমে বর্ণ, তারপর শব্দ চিনেছি, ক্রমে বাক্য পড়তে-লিখতে শিখেছি। কিন্তু জানেন কি, কলকাতারই এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে এর একেবারে উল্টো পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়। সেখানে বর্ণ থেকে শব্দ নয়, বরং শব্দ থেকে অক্ষর চেনার পাঠ দেওয়া হয়। অর্থাৎ ‘অ’ থেকে অজগর বা ‘আ’ থেকে আম নয়, ‘অজগর’ থেকে ‘অ’, ‘জ’, ‘গ’, ‘র’ এবং ‘আম’ শব্দটি থেকে ‘আ’, ‘ম’ অক্ষরগুলি চিনতে ও লিখতে শেখানো হয়। আবার প্রথমে অ, আ নয়; এখানে শিক্ষার্থীদের প্রথম শেখানো হয় ‘ঘ’,’র’, ‘ব’ -এর মতো অক্ষরগুলি।

মাথা কি গুলিয়ে যাচ্ছে? ভাবছেন, এটা আবার কীরকম শিক্ষা পদ্ধতি! কোথায় এভাবে পড়াশোনা শেখানো হয়? কেন-ই বা এরকম উল্টোভাবে পড়ানো হয়? আসলে, যেখানে জীবনযাত্রাটাই সম্পূর্ণ আলাদা, যে জায়গা তথাকথিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ, সেখানে শিক্ষা পদ্ধতিও যে উল্টো হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কলকাতার মধ্যেই রয়েছে একটা ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’। কোথায় জানেন? সোনাগাছি। সোনাগাছির মহিলাদের প্রথম যে শব্দটি শেখানো হয় এবং যে ভাবে শেখানো হয়, সেটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

‘সোনাগাছি’- নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে অপার বিস্ময়। বলা যায়, সোনাগাছি এলাকা থেকে সেখানকার মহিলা ও তাদের জীবনের পরতে-পরতে রয়েছে চমক। ফলে সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতিও যে বিস্ময়কর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখানে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বর্ণপরিচয়’ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজপাঠ’-এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার আলো ঢোকেনি। সোনাগাছিতে প্রথম শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছিল বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও সাহিত্যিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন শিক্ষা পদ্ধতির হাত ধরে।

‘ঘর’- শব্দ একটি হলেও এর অর্থ বহু। প্রতিটি মেয়েরই স্বপ্ন, নিজের ঘর হবে। আবার অনেকেই নিজের ঘর ছেড়ে বেশ্যাপল্লিতে এসে ‘পতিতা’ হতে বাধ্য হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ‘ঘর’ শব্দটির সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে রয়েছে সোনাগাছির যৌনকর্মীদেরও। আর এই আবেগকে ভর করেই ‘ঘর’ শব্দের মধ্য দিয়ে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া শুরু করেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ঘ’, ‘র’ চিনতে, লিখতে শিখল অন্ধকার গলিতে পতিত মহিলাগুলো।

একেবারে পাঠশালার মতো ক্লাস খুলে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের শিক্ষার প্রথম পাঠ দেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন তিনি তখনও ক্লাসে ঢোকেননি। ক্লাসের বাইরে থেকেই সন্দীপবাবুর কানে এল, “জানিস, আজ চুলের মুঠি ধরে টানতে-টানতে ঘরের বাইরে বের করে আনে। বলে কি না, শালি তোর এত বড় স্পর্ধা…!”– ক্লাসে উপস্থিত দুই যুবতী ছাত্রী (যৌনকর্মী) একে-অপরকে তাদের ‘দিনগত পাপক্ষয়ে’র বর্ণনা দিচ্ছিল। ‘বাবু’-দের মন জয় করার পরও ‘মাসি’-দের মন জয় করতে না পারলে এভাবেই গালিগালাজ শুনতে হয়। যে বলছিল, তার চোখ জলে চিকচিক করে উঠেছিল। পুরো বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন প্রাজ্ঞ সন্দীপবাবু। তারপর তিনি ক্লাসে ঢুকে সেই লজ্জাজনক, বেদনাময় ঘটনাটির মধ্য দিয়েই শিক্ষার আলো যৌনকর্মীদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। এখানে সবচেয়ে গ্লানির শব্দটি ছিল ‘শালি’। এই ‘শালি’ শব্দ দিয়েই পাল্টা অশিক্ষার অন্ধকার কাটানোর চেষ্টা করলেন সন্দীপবাবু। ব্ল্যাকবোর্ডে ‘শালি’ শব্দটি লিখে তিনি চেনালেন কোনটা ‘শ’ আর কোনটা ‘ল’। ‘শালি’ শব্দটি গালি অর্থে ব্যবহার হলেও এর যে অন্য ভাল অর্থ রয়েছে, সেটাও বোঝালেন সন্দীপবাবু। এভাবেই অতি সাধারণ, প্রচলিত বিভিন্ন শব্দ ভেঙে অক্ষর চেনানোর কাজ শুরু করেন তিনি।

সন্দীপবাবুর কথায়, “যাঁরা জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন খুব খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে, তাঁদের পক্ষে শিশুদের মতো অ, আ শেখা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা যেটায় আগ্রহ পাবে, সারাদিনে যে শব্দগুলি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়, যে শব্দগুলি তাদের পেশার সঙ্গে যুক্ত, সেগুলো দিয়েই শিক্ষা দেওয়া শুরু করি। শব্দ থেকে অক্ষর চেনানোর কাজ শুরু করি।”

‘ঘর’, ‘শালি’-র মতো একইভাবে বাবু শব্দটিও ভেঙে ‘ব’, ‘আ-কার’ (া), ‘উ-কার’ (ু)-এর মতো বর্ণ, চিহ্ন চিনিয়ে লিখতে ও পড়তে শেখানো হয় সোনাগাছির যৌনকর্মীদের। এভাবেই ধীরে-ধীরে ‘পতিতা’, ‘বারবণিতা’, ‘বেশ্যা’, ‘সোনাগাছি’র-র মতো মূলত পেশার সঙ্গে যুক্ত চেনা শব্দমালা থেকে অক্ষর চেনে তারা। আর এভাবেই সাধারণ শব্দভাণ্ডার থেকে শিক্ষার আলো ও জানার জিজ্ঞাসা যৌনকর্মীদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাই রাত জেগে ‘বাবু’দের খুশি করে, সারাদিনের কাজকর্ম করার পর শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়লেও সন্দীপবাবুর ক্লাস বাদ যেত না সোনাগাছির যৌনকর্মীদের। সন্দীপবাবু জানান, গোড়ায় ১০-১৫ জনকে নিয়ে ক্লাস শুরু করেন। ধীরে-ধীরে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ে। বাংলার মতোই ইংরেজির অতি প্রচলিত শব্দ, যেমন- Sorry, Thank You, Good Night, Good Morning ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ইংরেজি বর্ণ (Alphabet) চিনতে ও লিখতে শেখানো হয় সোনাগাছির মহিলাদের। এভাবেই সোনাগাছির অন্ধ-গলির মধ্যে ধীরে-ধীরে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করতে শুরু করে।

তখন সবে ডা. স্মরজিৎ জানার হাত ধরে ‘দুর্বার’-এর পথচলা শুরু। সংগঠনের সদস্য হিসাবে মাত্র গুটিকয়েক যৌনকর্মী নাম লিখিয়েছে। সংগঠনের সদস্য হওয়ার জন্য বা সন্দীপবাবুর ক্লাসে আসার জন্য কাউকে জোর করা হয়নি। তবে যারা ক্লাসে আসতে শুরু করেছিল, তাদের ও অন্যদের আগ্রহ বাড়াতে সংগঠনের তরফে বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল। সন্দীপবাবুর ক্লাস করার জন্য স্কুল ছাত্রীদের মতো আলাদা ইউনিফর্মও দেওয়া হয়েছিল সোনাগাছির যৌনকর্মীদের। সবুজ ও সাদা রঙের হালকা জ্যাকেট। শাড়ি বা চুড়িদারের উপর ওই জ্যাকেট পরে ক্লাসে আসত তারা। নতুন ও পুরানো ছাত্রীর পার্থক্য বোঝাতেই জ্যাকেটের রঙ আলাদা করা হয়েছিল। সন্দীপবাবুর কথায়, “এই ইউনিফর্ম পরে এবং গলায় আই-কার্ড ঝুলিয়ে নিজেদের গর্বিত মনে করত সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সোনাগাছির ওই মহিলারা। এই পোশাক ওদের অনেকটা নিরাপত্তাও দিত।” ধীরে-ধীরে দালাল, পুলিশ এদের থেকে তোলাবাজি করতেও পিছুপা হয়। এমনকি একসময়ে যারা দালাল, পুলিশ দেখলেই হেনস্থা হওয়ার ভয়ে পিছনে ছুটত, গলিতে ঢুকে মুখ লোকাত, ‘দুর্বার’-এর আই কার্ড, ইউনিফর্ম সোনাগাছির সেই মহিলাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। আর গলিতে ঢুকে মুখ লোকানো নয়, বরং কেউ তোলাবাজি করতে এলে, হেনস্থা করতে এলে সরাসরি ‘দুর্বার’-এর আই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে, চোখে চোখ রেখে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত। দালাল, এমনকি পুলিশও তাদের পাল্টা তীক্ষ্ম জবাব থেকে রেহাই পেত না। — এটাই তো চেয়েছিলেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আর যেন নতুন করে প্রতারিত না হয় সোনাগাছির মহিলাদের। তাঁর সেই প্রয়াস বিফলে যায়নি।

তবে কেবল অক্ষর জ্ঞান, প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ দিয়ে এবং আই কার্ড ও ইউনিফর্ম ঢাল করে পুলিশের তোলাবাজির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকা জরুরি বলে মনে করেন সন্দীপবাবু। তিনি বলেন, “পেশায় দেহ পশারিনী হলেও, শিক্ষায় ও তথাকথিত ভদ্রসমাজের দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও কেউ যাতে তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে না পারে, বাবু হোক বা পুলিশ- অযথা যাতে হেনস্থা করতে না পারে, সেই চেষ্টা করেছিলাম।” তাই দুর্বার’ সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রাক-লগ্নে ডা. স্মরজিৎ জানার হাত ধরে অ্যাডভান্সড ক্লাস করে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের বাংলা, ইংরেজির প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি Citizens Rights (নাগরিক সচেতনতা-এর পাঠ দেওয়ার কাজটিও শুরু করেছিলেন সন্দীপবাবু। তাঁর কথায়, “প্রত্যেকেরই নাগরিক অধিকার রয়েছে। সমাজের প্রতি যেমন দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে, তেমন তাঁদের কিছু অধিকারও প্রাপ্য রয়েছে। যৌনকর্মী বলে কেউ যাতে তাঁদের অকারণে হেনস্থা করতে না পারে, ভয় দেখিয়ে পুলিশও যাতে তাঁদের উপর অত্যাচার চালাতে না পারে, সেজন্য আমি অ্যাডভান্সড ক্লাস করে প্রয়োজনীয় কিছু সিটিজেনস রাইটস সম্পর্কে সচেতনতা দিই।”

এটা ছিল ৯০ -এর দশকের কথা। তারপর অনেক সময় পেরিয়েছে। ডা. স্মরজিৎ জানার প্রয়াণ হয়েছে। সংগঠন থেকে সোনাগাছির সামাজিক পরিস্থিতি, এমনকি সেখানকার যৌনকর্মীদের মানসিকতারও অনেক বদল হয়েছে। তবে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যেটা শুরু করেছিলেন, সেটা বর্তমানে অনেকাংশেই সফল হয়েছে। এখন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অনেকটাই সচেতন সোনাগাছি-সহ বিভিন্ন বেশ্যালয়ের যৌনকর্মীরা। শিক্ষার আলো ও জানার যে আকাঙ্খা সোনাগাছির পতিতাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন সন্দীপবাবু, সেটা আজ অনেকটাই সফল। তাই তো যৌনকর্মীদের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য ‘দুর্বার’-এর শাখা সংগঠন ‘আমরা পদাতিক’-এ সন্তানদের সঙ্গে শিক্ষার পাঠ নিতে আসেন প্রবীণ যৌনকর্মীরাও। কেবল পড়াশোনার পাঠ নেওয়া নয়, ‘আমরা পদাতিক’-এর সৌজন্যে আয়োজিত নাচ, নাটক-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেয় তারা। এখন আর তারা অন্ধকারের মধ্যে আবদ্ধ নয়, বরং নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে ময়দানে নেমেছে। ইতিমধ্যে যৌনপেশাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এবার শ্রমিকের অধিকার আদায় করে নিতে কোমর বেঁধেছে যৌনকর্মীরা।