সুরক্ষিত নয় আমাদের প্রাণের শহর কলকাতা! মহানগরের ভূমি বেশিমাত্রায় কেঁপে উঠলে, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে নগরের অট্টালিকা। ভূ-প্রাকৃতিক গঠনশৈলি এবং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মধ্যে কলকাতার অবস্থান যার অন্যতম কারণ। সেই পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলেছে অবৈধ নির্মাণ। ভূমিকম্প হলে অবৈধ নির্মাণের জন্যই কলকাতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মাত্রাছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। কলকাতার ক্ষেত্রে সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন অঞ্চলে ভূমিকম্পের জেরে মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। উত্তর কলকাতা, বরানগর, শ্যামবাজার অঞ্চলও একই ভাবে ধসে যেতে পারে। দমদম, কালীঘাট, যাদবপুরের মতো এলাকায় মাঝারি মানের ক্ষতি আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি হাওড়া-বালিও এই প্রভাবের বাইরে থাকবে না। কতটা বিপদে রয়েছে কলকাতা? এ বিষয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
দেশের কোনও এলাকায় ভূমিকম্প হলে সেখানে ভূমিকম্পের প্রভাব কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস। এ সংক্রান্ত একটি মানচিত্রও প্রকাশ করে তারা। সেই মানচিত্রে উল্লেখ থাকে কোন এলাকা কেমন ভূমিকম্প প্রবণ। অর্থাৎ দেশের কোন কোন এলাকায় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কতটা। কোথায় কোথায় বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে, কোন এলাকায় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা তুলনায় কম। এ জন্য ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের মানচিত্রে বিভিন্ন এলাকাকে জোন টু থেকে জোন ফাইভে ভাগ করা হয়েছে। জোন ২-এর অর্থ অতি মৃদু ভূমিকম্পের আশঙ্কা যেখানে। জোন ৫-এর অর্থ অতিপ্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। কলকাতার কিছু কিছু এলাকা জোন থ্রি-র মধ্যে পড়ে। তবে কয়েকটি এলাকা আবার জোন ফোরের অন্তর্ভুক্ত। তাই কলকাতায় ভূকম্পনের জেরে ক্ষয়ক্ষতির একটা আশঙ্কা থেকেই যায়।
কলকাতায় ভূকম্পের আশঙ্কা কতটা?
কলকাতা হুগলি নদীর ধারে অবস্থিত। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে এই শহর। এই শহরের নীচে রয়েছে বিস্তৃত পলিস্তর। আবার সেখানেই দিয়ে চলে গিয়েছে একটি চ্যুতি। ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, কলকাতার মাটির সাড়ে চার কিলোমিটার নীচ দিয়ে একটি চ্যুতি রয়েছে। যার নাম ‘ময়মনসিংহ-কলকাতা হিঞ্জ’ বা ‘ইওসিন হিঞ্জ’। সেখানে যা শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তা থেকে যে কোনও দিন রিখটার স্কেলে ৬.৫ মাত্রার ভূকম্প হতে পারে। যদিও এই ভূমিকম্প কবে বা কখন হবে, তার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনও প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। হুগলি নদীর অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় কলকাতার মাটির নীচে রয়েছে পলিস্তর। ভূমিকম্পের আশঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে মাটির নীচে থাকা এই পলির স্তর। ভূমিকম্প হলে সেই কম্পন এই পলিমাটির মধ্যে যত বেশি পাক খেতে খেতে উপরে উঠে আসবে, তত কম্পনের মাত্রা বাড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
কলকাতার সল্টলেক, নিউটাউন, রাজারহাটের মতো এলাকা আগে ছিল জলাভূমি। সেই জলাভূমি বুজিয়ে গড়ে উঠেছে এই সব এলাকা। সেখানে এখন বহুতলের জঙ্গল। সল্টলেক ছাড়া বাকি এলাকাগুলিতে গাছও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রাখবে সে সুযোগও নেই। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ওই সব এলাকার ভূস্তরে কম্পন হলে জল উঠে এসে মাটিকে নরম করে দেবে। কাদামাটি নরম হয়ে গিয়ে বহুতলের ভিত আলগা করে দেবে। তার ফলেই বাড়িগুলি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকবে বেশি। ভূকম্প হলে মধ্য এবং উত্তর কলকাতার একাংশে পুরনো বাড়িগুলি থেকেও বিপর্যয় ঘটার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়নে বাড়ছে বিপদ!
নগরায়নের চাপে দীর্ঘদিন ধরেই কলকাতায় বাড়ছে বহুতল নির্মাণ। কেবল বড় বড় বিল্ডিং নয়, সেই সঙ্গে মেট্রো রেল, ফ্লাইওভার ব্রিজও তৈরি হয়েছে একাধিক। গত কয়েক দশকে বহুতল তৈরির জন্য মহানগরীতে কাটা পড়েছে প্রচুর পরিমাণে গাছ। বর্তমানে সল্টলেক, ময়দানের মতো এলাকা ছাড়া কলকাতায় খুব কম এলাকা রয়েছে, যেখানে গেলে বৃক্ষের পর্যাপ্ত ছায়া পাওয়া যায়! বৃক্ষনিধনের পাশাপাশি জলাশয় ভরাট করে বহুতল তৈরির অভিযোগও নেহাত কম নয়। কলকাতা এবং শহরতলির একাধিক জায়গায় জলাশয় ভরাট হয়েছে, তার পর সেখানে মাথা তুলেছে ইট-পাথরের বহুতল। এ সবের জেরে কলকাতার ভূপ্রাকৃতিক ভারসাম্য যে বিঘ্নিত হয়েছে, সে বিষয়ে একমত বিশেষজ্ঞরা। গাছ কেটে বা জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা বহুতল আদেও কতটা নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
গত কয়েক বছরে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে যে অবৈধ নির্মাণের রমরমা বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বছর ১৭ মার্চ গভীর রাতে গার্ডেনরিচের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গার্ডেনরিচের ঘিঞ্জি এলাকাতেই তৈরি করা হচ্ছিল একটি বহুতল। সেই বহুতল তৈরির সময়ই ভেঙে পড়ে। বিল্ডিংয়ের চাঙড়, ভগ্নস্তূপ গিয়ে পড়ে আশপাশের ঝুপড়িতে। মধ্যরাতে এভাবে বহুতল ভেঙে বেশ কয়েকজনের প্রাণ যায়। আহতও হন অনেকেই। সেই ঘটনা রীতিমতো বিভীষিকা তৈরি করে নগরবাসীর মনে। উত্তেজনাও ছড়ায়।
এই ঘটনার পর একের পর এক অবৈধভাবে নির্মীত বহুতলের ছবি সামনে এসেছে। কতটা বিপজ্জনক ভাবে বাড়ি তৈরি হয়েছে কলকাতায়, তা দেখে বিস্মিতও হয়েছেন প্রশাসনের আধিকারিকরাও। যেখানে একতলা বাড়ির প্ল্যান পাশ হবে না, সেখানে সরু ফালির মতো দাঁড়িয়ে তিনতলা বাড়ি। কোথাও দুই বহুতলের মধ্যে নেই কোনও ফাঁকা জায়গা। এক বাড়ির দেওয়াল ও পাশের বাড়ির বাড়ি দেওয়াল এক সঙ্গে লেগে রয়েছে। জানলা দিয়েই এক বাড়ির বাসিন্দারা অন্যবাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে জিনিসপত্র আদানপ্রদান করতে পারবেন। এ রকম অবস্থাও কম নয়। এ ক্ষেত্রে যদি একটি বাড়ির ক্ষতি হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়বে আশপাশের সব বাড়িতেই। অর্থাৎ অপরিকল্পিত কাজের জেরে অল্প সমস্যায় বৃহৎ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এক জনের দোষের শাস্তি পেতে অনেককে!
গার্ডেনরিচ কাণ্ডের পর বেআইনি নির্মাণ ঠেকাতে একাধিক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কলকাতা পুরনিগম। অবৈধ নির্মাণ রুখতে এবং সে ব্যাপারে নজরদারি চালাতে একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছে। খোদ মেয়রও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একাধিক কনস্ট্রাকশন সাইটে বেআইনি নির্মাণের নোটিসও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবৈধ নির্মাণ যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তা বলার অবস্থা তৈরি হয়নি। গার্ডেনরিচের বহুতলটি ঢালাইয়ের কয়েক ঘণ্টা পরই ভেঙে পড়েছিল। সামান্য বহুতল তৈরির সময়ই যদি এই পরিস্থিতি হয়, তাহলে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী হবে কলকাতার? বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধ ভাবে নির্মীত বহুতলগুলি আদেও কতটা মজবুত, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কলকাতার এই অবৈধ নির্মাণই ভূমিকম্পের জেরে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তা যদি হয়, তখন কপাল চাপড়ানো ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না কলকাতাবাসীর। নগরোন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া এই সমস্যার মোকাবিলার বিকল্প কোনও পথও নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কলকাতায় অবৈধ নির্মাণ এবং ভূমিকম্প হলে বিপর্যয় মোকাবিলা আদেও কতটা সম্ভব সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল কলকাতা পুরনিগমের মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কাছে। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, “শহরের একাধিক অংশ রয়েছে যেগুলো ভূমিকম্প প্রবণ। আমরা সেই কারণেই বহুতল নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার সময় ভূগর্ভের অবস্থা খতিয়ে দেখার কথা বলে থাকি। শহরের যে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলি রয়েছে, সেগুলোর জন্য বাড়তি সতর্ক রয়েছে কলকাতা পুরনিগমের। যে কারণে ভূমিকম্প হলে যদি কোনও বিপর্যয় ঘটে, তার জন্য আগাম যন্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও আমরা প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিয়েছি।”