এই নবাবের বিয়ের খরচ ছিল ৩০ লক্ষ, কিন্তু কলকাতায় কবর তৈরিতে খরচ হয়েছিল মাত্র ১০ টাকা

TV9 Bangla Digital | Edited By: Shubhendu Debnath

Dec 29, 2021 | 6:46 PM

Wazir Ali Khan: ওয়াজির আলি ছিলেন আওয়াধের চতুর্থ নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লার পালিত পুত্র। ওয়াজিরের মা ছিলেন একজন পরিচারিকা। নবাব হয়ে মসনদে বসার আগে ওয়াজিরের জীবন ছিল সুখ সমৃদ্ধিতে ভরা, কিন্তু একজন পরিচারিকার ছেলে হয়ে মসনদে বসতেই ভাগ্যের চাকা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করে তাঁর।

এই নবাবের বিয়ের খরচ ছিল ৩০ লক্ষ, কিন্তু কলকাতায় কবর তৈরিতে খরচ হয়েছিল মাত্র ১০ টাকা
নবাব ওয়াজির আলি খানের কবর, যা তৈরি হয়েছিল মাত্র ১০ টাকায়

Follow Us

নবাবী জাঁকজমকের কথা কে না জানে, নবাবপুত্তুদের বিয়ে হোক বা কোনও পোষ্যদের বিয়ে, খরচের কোনও কমতি হত না। কিন্তু ইংরেজ শাসনে নবাবী খরচে টান পড়তেও দেখা গিয়েছে। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্কিত এমন এক নবাবও রয়েছেন, যার বিয়েতে খরচ হয়েছিল সেই সময়ের হিসেবে ৩০ লক্ষ টাকা, অথচ মৃত্যুর পর কলকাতায় তাঁর কবর তৈরি হয়েছিল ১০ টাকায়।

রবীন্দ্রসদন মোড় বা এক্সাইড মোড় থেকে পশ্চিম বরাবর গেলেই আসে উডবার্ন পার্ক। তার ঠিক পাশেই অবস্থিত অভিজাত ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব। অনেকেই জানেন না আজ যেখানে এই পার্ক আর ক্লাব এক সময় সেখানেই ছিল এক বিশাল কবরখানা, যার নাম কাসিয়াবাগান গোরস্থান। এই কবরখানাটি ছিল নবাবদের চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার জায়গা। কালের অতলে তা হারিয়ে গেলেও গুরুত্বের দিক থেকেই তা জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এই কবরখানায় থাকা সারি সারি কবরের মধ্যে একটি কবর এক হতভাগ্য নবাবের। তিনি আওয়াধের নবাব ওয়াজির আলি খান, যার জীবনের সবচেয়ে করুণ অধ্যায় শুরু হয়েছিল আওয়াধ থেকেই।

ওয়াজির আলি ছিলেন আওয়াধের চতুর্থ নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লার পালিত পুত্র। ওয়াজিরের মা ছিলেন একজন পরিচারিকা। নবাব হয়ে মসনদে বসার আগে ওয়াজিরের জীবন ছিল সুখ সমৃদ্ধিতে ভরা, কিন্তু একজন পরিচারিকার ছেলে হয়ে মসনদে বসতেই ভাগ্যের চাকা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করে তাঁর।

নবাব ওয়াজির আলির পালক পিতা আসাফ-উদ-দৌল্লা ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সেই সময়ের হিসেবে বিয়েতে খরচ হয়েছিল ৩০ লাখ টাকা। নিজের ছেলেকে সম্মান জানাতে নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা পায়ে হেঁটে বরযাত্রী গিয়েছিলেন। তাঁকে ঘোড়ায় চড়তে অনুরোধ করা হলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। এই বিয়েতে অর্থ খরচ করেছিলেন টিকাইত রাই, আলমাস খান, জওহর আলি খান, তসির আলি খান এবং বহু বেগম-এর মতো সেই সময়ের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা।

১৭৯৭ সালে ওয়াজিরের সতেরো বছর বয়সে মারা যান আসাফ-উদ-দৌল্লা। সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পঞ্চম নবাব হিসেবে মসনদে বসেন ওয়াজির। কিন্তু কপালের ফেরে মাত্র চার মাস তিনি রাজ্য চালাতে পেরেছিলেন। আসলে তাঁকে বেনারসে নির্বাসনে পাঠায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল এই নির্বাসনের পেছনে।

মসনদে বসার চার মাসের মধ্যে আসাফ-উদ-দৌল্লার এক আত্মীয় দ্বিতীয় সাদাত আলি খান অভিযোগ তোলেন নবাবের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই ওয়াজিরের। তিনি ব্রিটিশদের পরামর্শ দেন যদি তাঁকে মসনদে বসানো হয় তাহলে তিনি ইংরেজদের সমস্ত রকমের সহায়তা দেবেন। নবাবের সঙ্গে ওয়াজিরের রক্তের সম্পর্ক আছে কি না তা নিয়ে তদন্তের ভার পড়ে গর্ভনর জেনারেল জন সোরের উপর। তিনি তদন্ত শুরু করেন। শেষপর্যন্ত ওয়াজিরকে অসৎ ও ইংরেজের পক্ষে ক্ষতিকারক প্রমাণ করে সরিয়ে দেওয়া হয় মসনদ থেকে।

দেড় লক্ষ টাকা বার্ষিক ভাতার বিনিময়ে নবাবকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল বেনারসে। মাত্র ১২ জন সৈন্য নিয়ে জেনারেল সোরে ওয়াজিরকে সরিয়ে সাদাতকে মসনদে বসান। নবাব ওয়াজির ভিতরে ভিতরে পরিকল্পনা আঁটছিলেন ওই চক্রান্তের পাল্টা জবাব দেওয়ার। ১৭৯৯ এর ১৪ই জানুয়ারি, রেসিডেন্ট লর্ড চেরীর দরবারে ওয়াজিরের ডাক পড়লো। বেনারসের পরে তাঁর নির্বাসন ঠিক কোথায় হবে সেটাই স্থির হওয়ার কথা ছিল সেই দরবার। ওয়াজির সেই দরবারে গেলেন। সেই সঙ্গে লুকিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর অনুগত কিছু ফৌজ। তারা হত্যা করল চেরীকে এবং সেই দরবারে উপস্থিত থাকা ক্যাপ্টেন কনওয়ে ও মিস্টার গ্রাহামকেও।

এরপর ওয়াজির বেনারসের ম্যাজিস্ট্রেট স্যামুয়েল ডেভিসের বাড়ি আক্রমণ করে বসলেন। কিন্তু ডেভিস একটি মাত্র বর্শা নিয়ে লড়াই করে ঠেকিয়ে রাখলেন ওয়াজিরদের। যদিও তার কিছুক্ষণ পরে ব্রিটিশ বাহিনী এসে পড়ায় ওয়াজিরকে সরে পড়তে হয়। তিনি পালিয়ে যান দাক্ষিণাত্যের বেরার প্রদেশে। কিন্তু ইংরেজের অনুসন্ধিৎসু চোখের বাইরে থাকা বেশিক্ষণ সম্ভব হয় তার পক্ষে। ওয়াজির ধরা পড়লেন। তাঁকে সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হলো কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। সেখানে ১৭ বছর বন্দি অবস্থায় কাটান তিনি। পরে, ১৮১৭ সালের ১৫ই মে তাঁর দেহাবসান হয়। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর।

আওয়াধের পঞ্চম নবাব ওয়াজির আলি খানকে কবর দেওয়া হয়েছিল এই কাসিয়াবাগান গোরস্থানেই। ইংরেজ সরকার মাত্র ৭০ টাকা বরাদ্দ করেছিল তাঁর শেষকৃত্যে। ৩০ লক্ষ টাকা খরচ করে যাঁর বিয়ে হয়েছিল, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর শেষকৃত্যের খরচ ৭০ টাকা, যার মধ্যে কবর তৈরিতে খরচ হয়েছিল মাত্র ১০ টাকা। মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে নির্বাসিত আওয়াধের নবাবের সমাধি ক্ষেত্রের উপরেই বর্তমানে নির্মাণ করা হয়েছে উডবার্ন পার্ক এবং পার্কের সংলগ্ন কলকাতা সাউথ ক্লাবটি।কে জানে এই কলকাতা সাউথ ক্লাবের মজলিসের মধ্যেই কবরের ভেতরে শুয়ে আজও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলেন এক নির্বাসিত নবাব।

আরও পড়ুন: Hooghly: টাচ ফ্রি- পোর্টেবল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে কেন্দ্রের পেটেন্ট পেলেন নবম শ্রেণির অভিজ্ঞান

Next Article