চিরতরে ‘শব্দহীন’ শঙ্খ, ‘শূন্যতা গ্রাস করছে’ শীর্ষেন্দুর, ‘ক্রমশ একা’ হয়ে যাচ্ছেন সঞ্জীব

tista roychowdhury |

Apr 21, 2021 | 9:35 PM

শুধুই কি লেখা? নবনীতা দেবসেন তাঁর 'ভালবাসার বারান্দায়' একবার লিখেছিলেন, শঙ্খ ঘোষ আর তিনি কীভাবে যাদবপুরে ক্লাস সেরে পড়ন্ত বিকেলে ঝালমুড়ি খেতে খেতে এইটবি এসেছিলেন। রোদ ফুরানো সেই বিকেলবেলা যে অন্য শঙ্খকে চিনিয়েছিল সেই কথাই যত্নে লিখেছিলেন নবনীতা।

চিরতরে শব্দহীন শঙ্খ, শূন্যতা গ্রাস করছে শীর্ষেন্দুর, ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছেন সঞ্জীব
চলে গেলেন কুন্তক, অলংকরণ: অভীক দেবনাথ

Follow Us

কলকাতা: তিনি লিখেছিলেন, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও/লেখো আয়ু লেখো আয়ু/ চুপ করো, শব্দহীন হও।’  শব্দহীনতার মধ্য়ে যে মর্মস্পর্শী এত শব্দ-অভিঘাত লুকিয়ে থাকে, ‘নেই’-এর মধ্যেও যে থেকে যাওয়ার অস্তিত্ব, তা চিনিয়েছিলেন তিনি। ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে খ্যাত, তিনি শঙ্খ ঘোষ। ২১ এপ্রিল ২০২১ ক্যালেন্ডারের পাতার সেই একটি দিন, যে দিনে গোটা একটি যুগের অবসান দেখল বাংলা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেল কবি শঙ্খকে। শোকে মুহ্যমান বাংলা।

গত ১৪ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই একান্তবাসে ছিলেন অশীতিপর কবি। সকলের সঙ্গে যোগাযোগও কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে শঙ্কিত ছিল সাহিত্যিক মহল। গত রাতে তাঁর আচমকা শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ক্রমশ তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করলে ভেন্টিলেশনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু, চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বুধবার সকাল ১১ টা ১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি।

একরাশ শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই…

কিছুদিন আগেই গিয়েছে জন্মদিন। নব্বইয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে জীবনকে নতুন করে চেনার পাঠ দিয়েছিলেন তিনি। শঙ্খের মৃ্ত্যু একটি যুগের অবসান কেবল নয়, যেন ইতিহাসের একটি মুক্ত দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় শোকপ্রকাশ করে বলেন, “শঙ্খ ঘোষের মতো এমন নিবিষ্ট কবি আমি দেখিনি। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। এমন সহজ সরল মিষ্টি মানুষ আমি কম দেখেছি। এমন পরিমিত রসবোধ আমি কম দেখেছি। নিজে রসিকতা করতেন না, তবে অন্যের রসিকতায় হাসতেন। একরাশ শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই! মাথার উপর থেকে গাছের ছায়া সরে গেল যেন!”

পরের জন্মে যেন দেখা হয়…

প্রবীণ হয়েও নবীন তিনি। সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠ জুড়ে কেবল স্মৃতির হাহাকার। বললেন,  “ছেলেবেলা থেকে ‘বাবরের প্রার্থনা’ খুব আবৃ্ত্তি করতাম। পরে বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে। প্রথম উপহার তাঁর সুন্দর হাসি। পরের জন্মে আবার যেন তিনি আমার আগে জন্মান। আবার এমন লেখেন। আবার যেন দেখা হয়। বারবার যেন ফিরে আসতে পারি। তিনি গেলেন। আরও একা হয়ে গেলাম।”

ওঁর ভেতরে আনন্দ ছিল…

জীবন জুড়ে কেবল জয়গানের ছবিই এঁকেছিলেন তিনি? কোনও গ্লানি, অভাববোধ কিছুই কি ছিল না? রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে যখন বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ-অমিয়রা রবীন্দ্র বলয়কে ছিন্ন করতে তৎপর, তার অনতিপরেই বাংলা সাহিত্যের এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এল শক্তি-সুনীল-বিনয়দের হাত ধরে তখন সদ্য চারাগাছ থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছেন শঙ্খ-জয়রা। সুনীলরা তাঁর সতীর্থ না হলেও শঙ্খ ছিলেন তাঁদের আশীর্বাদধন্য। বাংলার ইতিহাসে তখন হাংরি আন্দোলন হয়ে গিয়েছে। নকশাল আন্দোলনের চোরা স্রোত তখনও বর্তমান। শঙ্খের লেখনীতে তাই বিরহ ছিল, আর্তনাদও। কিন্তু, জীবনের প্রতি অপরিসীম মায়া হারিয়ে যায়নি তাঁর। কবি সুবোধ সরকার বললেন,  “আমি শোকাহত নই, হতবাক। বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। যোগাযোগ বিশেষ ছিল এমনটা বলব না। শেষের দিকে বিশেষ কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু জীবনটাকে বাঁচতে জানতেন। উদযাপন করতে জানতেন। ওঁর ভেতরে আনন্দ ছিল। আজ এক সাধনার মৃত্য়ু হল।”

বহু অজ্ঞাত অখ্যাতরাও তাঁর কাছে প্রশ্রয় পেত…

তিনি কবি। প্রাবন্ধিক। সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের মহীরূহ। এ সবই চেনা উপাধি। কিন্তু, এর বাইরে? ব্যক্তি শঙ্খকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গলা ভার কবি একরাম আলির। বললেন,  “শঙ্খ বাবুর সঙ্গে আজ থেকে নয়, চুয়াল্লিশ বছর আগেকার সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক তিনি। কিন্তু আর? অল্প কথায় কী চমৎকার রসবোধ! গভীর জ্ঞান, পড়াশোনা, কত চর্চা করেছি একসঙ্গে। দেখেছি, দিনের পর দিন কত অনামী-বেনামী, অজ্ঞাত, অখ্যাতরাও তাঁর কাছে প্রশ্রয় পেত। সেইসব তরুণ কবিদের লেখা সংশোধন করতেন কত! অথচ ওসব তাঁর দেখার কথাই ছিল না! তবু করতেন! ওঁর থেকেই শিখেছি মানুষকে কীভাবে সম্মান করতে হয়!”

তিনি সেতুবন্ধন করতে পেরেছিলেন… 

একদা, জয় গোস্বামী তাঁর ‘হৃদয় প্রেমের শীর্ষে’ তাঁর প্রবল অস্থির জীবনের মধ্যে ‘নিজের জীবন বীজের জীবনের’ সন্ধান করেছিলেন, সন্ধান করেছিলেন দুই পর্যায়ের মধ্য়ে কীভাবে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। সেই খুঁজে পাওয়ার দায়িত্ব যেন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলছেন, “আমি মর্মাহত। আসলে কম কথা বলা একজন কবির কলম যে এত কথা বলতে পারে তা বুঝিয়েছিলেন শঙ্খবাবু। যুগের থেকে এগিয়ে ছিলেন অনেকটা। তাঁর অনুভবের মধ্যে, লেখনীর মধ্যে সেতুবন্ধনের সফল চেষ্টা বরাবর বিদ্যমান। আজ বলতে পারি সূর্যের মতো এক কবির অবসান হল।”

আমরা বড় হয়েছি ওঁর লেখনীতে…

শঙ্খ ঘোষ কেবল কবি হয়ে থাকেননি। তাঁর পরিসর জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রবিজ্ঞায় আলোকিত শঙ্খের গবেষণায় এসেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো মৃণালিনী দেবীরা। ছোটরা শিখেছে, ‘মিথ্যে কথা’, ‘যমুনাবতী’, ‘ময়নাবতী’। নাট্যকার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু বললেন,  “আমার শৈশব জুড়ে শঙ্খবাবুর লেখাই পেয়েছি। ওঁর লেখা পড়েই বেড়ে ওঠা। ভেবেছিলাম, স্যর সুস্থ হয়ে উঠবেন। অপূরণীয় ক্ষতি। কিছু বলার নেই। সেইসব লেখা আর কেউ লিখবে না। মণীন্দ্র গুপ্তও চলে গিয়েছেন।”

কবিতাটি আজও যত্নে রেখেছি…

শুধুই কি লেখা? নবনীতা দেবসেন তাঁর ‘ভালবাসার বারান্দায়’ একবার লিখেছিলেন, শঙ্খ ঘোষ আর তিনি কীভাবে যাদবপুরে ক্লাস সেরে পড়ন্ত বিকেলে ঝালমুড়ি খেতে খেতে এইটবি এসেছিলেন। রোদ ফুরানো সেই বিকেলবেলা যে অন্য শঙ্খকে চিনিয়েছিল সেই কথাই যত্নে লিখেছিলেন নবনীতা। শিল্পী হিরণ মিত্রের স্মৃতি জুড়ে তেমনই এক যত্নের কথা। বললেন, “১৯৯৫ সালে আমার চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ছবি দেখে ৫ লাইনের একটা কবিতা লিখেছিলেন সেখানে বসে। সেই কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে আমার এগজিবিশন উদ্বোধন হয়েছিল। কবিতাটি আজও যত্নে রেখেছি।”

চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই…

কবি শঙ্খ, সাহিত্যিক শঙ্খ, ব্যক্তি শঙ্খ। শিখিয়েছেন কবিতার ঊষালগ্ন থেকে সাহিত্যর অন্তহীন পাঠপরিক্রমা। তাঁর মৃত্যুতে ‘চুপ করে বসে থাকার’ মতো কঠিন নীরব অথচ মর্মস্পর্শী আর্তি কবি রাহুল পুরকায়স্থের।

কবির প্রয়াণে কেবল সাহিত্য জগত নয়, শোকবার্তা এসেছে রাজনৈতিক মহল থেকেও। টুইট করে শোক জ্ঞাপন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। টুইট করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও।

বাদ যাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বালুরঘাটে সভা করতে গিয়েই স্মরণ করেছেন শঙ্খকে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ সম্মানের প্রাপক শঙ্খকে হারিয়ে মর্মাহত তিনি। একদা কবির লেখনীতে আঙুল তোলা তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের সুরও নরম আজ। বলেছেন, ”এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। বাংলার কবি ছিলেন। ওঁকে শতকোটি প্রণাম জানাই। শঙ্খ ঘোষ একটা ভাল কবি ছিলেন। ওঁর মৃত্যুতে মর্মাহত হবে বাংলা।’’ শোকস্তব্ধ বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বললেন,  “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ে তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছিলেন তা আজকের দিনে স্মরণে রাখতে হবে।সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কণ্ঠ আজ নীরব হয়ে গেল!”

শুধু দশের কবি নন, অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের হাত ধরে দিশা দেখেছিলেন কত পড়ুয়া। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন শঙ্খ। কত পড়ুয়ারা তাঁর স্নেহচ্ছায়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন। বাংলা বিভাগের পুর্নমিলন পত্রিকার প্রথম পাতার সম্পাদকীয় মানেই শঙ্খ ঘোষ। রাজনীতি, প্রেম, কবিতা, শুধু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা নয়, উঠে আসা জীবনকে দেখতে পাওয়ার কথা জানালেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীয় অধ্যাপক আব্দুল কাফি।

‘নিঃশব্দের তর্জনীর’ ভূমিকায়  শঙ্খ লিখেছিলেন, ‘…কবিতা শেষ অবধি একটা সৃষ্টির কাজ। তাই যখনই দেখতে পাই যে এই এক একটি লেখা হয়ে উঠছে এক একটি সৃষ্টি আর এই একটি অভিজ্ঞতা যা এই প্রথম যেন জেগে উঠল কবির মনে তখনই তাকে বলতে চাই কবিতা।’ সময়ের দেশের বাসিন্দা শঙ্খ নিজেই বলেছেন, ‘কথাগুলি যেন স্তর থেকে স্তরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে, ভিড় থেকে দূরে,একারই কোনো কেন্দ্রে, নিজের একেবারে মুখোমুখি।’ আজ সেই স্তর থেকে স্তরে সরে গিয়ে যেন আড়ালে গিয়ে, শব্দহীন হয়ে যেন অনাবরত নিজের থাকাটাই জানান দিয়ে অনন্তের পথে শঙ্খযাত্রা।

আরও পড়ুন: নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনতে শিখিয়েছেন তিনি, ৯০-এর দোরগোড়ায় আজ কবি শঙ্খ ঘোষ

Next Article