নেল পলিশটা দেখ। কেমন লাগছে?
প্রশ্নটা করেই ইপ্সিতার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল বিদীপ্তা। দু’হাতের দশটা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে নেল পলিশ। আঙুলগুলোর দিকে কয়েক মুহূর্তে তাকিয়ে রইল ইপ্সিতা। বলল, দারুণ তো। কোথায় কিনলি? বিদীপ্তা উত্তর দিল, টিভিতে অনুষ্কা শর্মার অ্যাডে এই নেল পলিশটা দেখেছি। তারপরই অনলাইনে অর্ডার দিয়েছিলাম। গতকাল এসেছে।
ট্রেনে চেপে কলেজে যাচ্ছে দুই বান্ধবী। আর কামরায় তাদের এই কথোপকথনের টুকরো-টুকরো অংশ এসে ঢুকছে কানে। বারবার একটা কথা বাজছে কানে, টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে নেল পলিশটা নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তার। সত্যিই তো। বিজ্ঞাপনই তো আমাদের সঙ্গে পণ্যের পরিচয় করায়। তারপর ভাল-মন্দ গ্রাহকের পছন্দের উপর নির্ভর করে। ট্রেনের কামরায়ও নানা বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে। কোনটা চাকরির বিজ্ঞাপন। কোনটা ভূত-প্রেত ছাড়ানোর বিজ্ঞাপন।
পথে-ঘাটে রাস্তার দু’ধারে হোর্ডিংয়ে ছয়লাপ। বিজ্ঞাপনে ভরা। টিভিতে সিনেমা, সিরিয়ালের মাঝে বিজ্ঞাপন। সিনেমা-সিরিয়ালের মতো সেই বিজ্ঞাপনেও মজে মানুষ। অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে খেলোয়াড, বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় সবার মুখ দেখা যায়। ট্রেনের কামরায় ইপ্সিতা-বিদীপ্তার কথোপকথন শুনছিলেন দুই অশীতিপর বৃদ্ধও। তাঁরা একবার চোখ তুলে দেখলেন দুই কলেজপড়ুয়া যুবতীকে। তারপর ডুব দিলেন স্মৃতির সাগরে। বিজ্ঞাপন তো তাঁদের সময়েও ছিল। স্বাধীনতার আগেও দেশে বিভিন্ন পণ্য়ের বিজ্ঞাপন হয়েছে। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জড়িয়ে রয়েছেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে। একটা-আধটা নয়, প্রায় শ’খানেক বিজ্ঞাপনে জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। বাংলার মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ছবিও দেখা গিয়েছে একটি সাবানের বিজ্ঞাপনে।
বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-
তখন ভারত শাসন করছে ব্রিটিশরা। এ দেশ থেকেই কাঁচামাল, অর্থ, শ্রমিক-এককথায় পণ্য উৎপাদনের সব উপকরণ সংগ্রহ করছে। তারপর সেই পণ্য এ দেশের বাজারে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিতে নেমেছে কয়েকটি দেশীয় সংস্থা। বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভের আশায় তারা নেমেছিল, এ কথা যেমন ঠিক। তার সঙ্গে জুড়ে ছিল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের হাত ধরে জোয়ার এল স্বদেশি ব্যবসায়। বিদেশি পণ্য বয়কট আর স্বদেশি পণ্য ব্যবহার বাড়ল। দেশীয় পণ্যকে ছড়িয়ে দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে দ্বিধা বোধ ছিল না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তবে তার আগেই অবশ্য দেশীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছে বিশ্বকবিকে। সবমিলিয়ে প্রায় শ-খানেক বিজ্ঞাপনে নিজের মন্তব্য, উক্তি, এমনকি ছবি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন কবিগুরু।
ভারতীয় রেল থেকে ঘি-দই-সাবান, কী ছিল না সেই বিজ্ঞাপনের তালিকায়-
মহীশূরের রাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার ও টাটা গোষ্ঠীর পর ১৯১৮ সালে দেশে সাবান তৈরি শুরু করেন আর্দেশির এবং পিরোজশা গোদরেজ। সেই সময় সাবানের অন্যতম উপকরণ ছিল পশুর চর্বি। সাবানে পশুর চর্বি থাকায় বহু ভারতীয় তা ছুঁয়ে দেখতেন না। তা লক্ষ্য করেই দেশীয় বাজারে প্রথম চর্বিমুক্ত সাবান নিয়ে আসেন গোদরেজ সংস্থা। ‘চাভি’ নামে এই ব্র্যান্ডের সাবানগুলির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নম্বর টু’। বছর চারেক পর দ্বিতীয় পর্বে নম্বর ওয়ান সাবান বাজারে আনে গোদরেজ। আর এর বিজ্ঞাপন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বিজ্ঞাপনের ছবিতে দেখা যায়, হাত দুটো কোলের সামনে রেখে বসে আছেন বিশ্বকপি। ছবির পাশে লেখা, “I know of no foreign soaps better than Godrej’s and I will make a point of using it.”
চিকিৎসক উমেশচন্দ্র রায়ের ‘পাগলের মহৌষধ’ নামে একটি ওষুধের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি তো প্রবাদ হয়ে গিয়েছিল। পাগলের মহৌষধের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি।” বিশ্বকবির ওই লেখার উপরের ওষুধটি কী কী রোগে খাওয়া যাবে তা লেখা ছিল। প্রথমে লেখা ছিল, ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে লক্ষ লক্ষ দুর্দান্ত পাগল ও সর্বপ্রকার বায়ুগ্রস্ত রোগীদের সারিয়েছে। তারপর লেখা ওষুধটি মূর্ছা, মৃগী, অনিদ্রা, হিস্টিরিয়া, অক্ষুধা, স্নায়বিক দুর্বলতা-সহ বিভিন্ন রোগে কার্যকরী।
এছাড়া বোর্নভিটা, কুন্তলীন কেশ তেল, রেডিয়ম ক্রিম, বাটা-র জুতো, ডোয়ারকিন হারমোনিয়াম, সমবায় বিমা, কটন মিল, মিষ্টির দোকান, ঘি, দই, কাজল-কালি, পেন্টওয়ার্কের মতো হরেক পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপনে খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথকে। হেমেন্দ্রনাথ বসুর কুন্তলীন তেলের প্রচারে বিশ্বকপি একটি জিঙ্গলও লিখেছিলেন, “কেশে মাখ ‘কুন্তলীন’/রুমালেতে ‘দেলখোস’ /পানে খাও ‘তাম্বুলীন’/ ধন্য হোক্ এইচ বোস।” একইসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছে।”
দেশীয় পণ্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেমন বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অনেকে বলেন, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহও তাঁর বিজ্ঞাপন জগতে আসার কারণ।
বিজ্ঞাপনে সুচিত্রা সেন-
ঐশ্বর্য রাই থেকে শ্রীদেবী। আবার দীপিকা পাড়ুকোন থেকে ক্যাটরিনা কাইফ। লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে বলিউড়ের তাবড় তাবড় অভিনেত্রীদের দেখা গিয়েছে। টলিউড অভিনেত্রী রাইমা সেনও লাক্সের বিজ্ঞাপন করেছেন। রাইমা যে বিজ্ঞাপনের অংশ হলেন, ষাট বছরের বেশি আগে সেই বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল বাংলা সিনেমার মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে। ১৯৫৫ সালে হিন্দিতে দেবদাস সিনেমায় ‘পারো’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা। সেইসময় লাক্সের বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, সুচিত্রা সেন পছন্দ করেন লাক্স।
মহানায়ক উত্তম কুমার কি কখনও বিজ্ঞাপন করেছেন?
তিনি বাঙালির ম্যাটিনি আইডল। তাঁর ওই হাসি। চোখের চাহনি। মৃত্যুর ৪৪ বছর পরও বাঙালির মননে মহানায়ক উত্তমকুমার। কিন্তু, তিনি কি কখনও কোনও বিজ্ঞাপন করেছেন? নেট-দুনিয়ায় অনেক খুঁজেও কোনও বিজ্ঞাপনে উত্তমকুমারের ‘হদিশ’ পাওয়া গেল না। উত্তমকুমার বিজ্ঞাপন করেছেন কি না স্মরণ করতে পারলেন না টলিপাড়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন প্রবীণ ব্যক্তিও।
উত্তমকুমার কি কোনওদিন বিজ্ঞাপন করেননি? প্রশ্ন শুনে একটু থমকালেন তাঁর ভাইঝি তথা অভিনেতা তরুণকুমারের কন্যা মনামী বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক মুহূর্ত থেমে বললেন, “না, বিজ্ঞাপন করেননি। আমি অন্তত তাঁকে কখনও বিজ্ঞাপন করতে দেখিনি।” কিন্তু, সেই সময়ও তো বিজ্ঞাপন হত? অনেকেই বিজ্ঞাপন করেছেন, তাহলে মহানায়ক কেন বিজ্ঞাপন জগতে পা রাখেননি? তরুণ-কন্যা বললেন, “কেন বিজ্ঞাপন করেননি, সেটা আমি বলতে পারব না। আসলে তখন তো এত বিজ্ঞাপনের ব্যাপার ছিল না। কীসের উপর বিজ্ঞাপন করবেন। উনি ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাছাড়া উত্তমকুমারের বিজ্ঞাপনে কাজ করা মানে তখন খেলোমি।”
বিজ্ঞাপনের দুনিয়া-
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞাপনের প্রভাব শুধু এখন নয়। বহু বছর আগে থেকেই বিজ্ঞাপনের প্রভাব রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে বদলায় বিজ্ঞাপনের ধরন। রেডিও, টেলিভিশনের পর এখন মোবাইলে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বিজ্ঞাপন। ২০১১ সালের হিসেব বলছে, আমেরিকায় ওই বছর বিজ্ঞাপনের পিছনে ১৪৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। আর বিশ্বজুড়ে সেই ব্যয়ের হিসেব ৪৬৭ বিলিয়ন ডলার। শুধু এই পরিসংখ্যানই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বিজ্ঞাপনে এখন কেমন খরচ হয় বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের একাধিক দেশে তামাকের বিজ্ঞাপন দেখানো নিষিদ্ধ।
আধুনিক বিজ্ঞাপনের জনক বলা হয় থমাস জেমস বারাটকে। ১৮৪১ সালে জন্ম ব্রিটেনের এই ব্যবসায়ীর। এ অ্যান্ড এফ পিয়ার্স সাবান সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর কোম্পানির সাবানকে জনপ্রিয় করতে নতুন নতুন বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যায় বাজার। আর সেইসব বিজ্ঞাপনের স্লোগানে মজতেন আম নাগরিক। ‘গুড মর্নিং, আপনি কি পিয়ার্স সাবান ব্যবহার করেছেন?’ সেইসময় এই স্লোগান খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৯১৪ প্রয়াত হন থমাস। তাঁর মৃত্যুর পরও পিয়ার্স সাবানের এই স্লোগান মানুষের মনে গেঁথে ছিল বহু বছর।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বদলের দরকারের কথাও বলে গিয়েছেন থমাস। ১৯০৭ সালে তিনি বলেছিলেন, “পছন্দ বদলাচ্ছে, ফ্যাশন বদলাচ্ছে, তার সঙ্গে বিজ্ঞাপনেরও বদল দরকার। এক প্রজন্ম আগে যে আইডিয়া কার্যকরী ছিল, সেটা এখন মানুষের কাছে নিয়ে এলে ব্যর্থ হবে। এর মানে এই নয় যে বর্তমান ভাবনা সবসময় পুরনো আইডিয়ার চেয়ে ভাল। কিন্তু, এটা অন্যরকম। এটা মানুষের বর্তমান পছন্দকে উৎসাহিত করে।”
বদলাচ্ছে দুনিয়া। বদলাচ্ছে মানুষের পছন্দ, চাহিদা। তার সঙ্গে বদলাচ্ছে বিজ্ঞাপনের ধরন। কিন্তু, কিছু কিছু বিজ্ঞাপন মানুষের মনে গেঁথে যায়। পুরনো সেই দিনের কথা মনে পড়ায়। এ যেন বিজ্ঞাপনের বিজ্ঞাপন। অতীতকে খোঁজার বিজ্ঞাপন…