Sadhan Pandey Death : ‘কংগ্রেস আমার মা, মমতা আমার বোন’
Sadhan Pandey : আজ সকালে মুম্বইয়ের হাসপাতালে প্রয়াত হন রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। প্রথম কংগ্রেসে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও পরে তৃণমূলের হয়েই বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্য পেয়েছেন পরপর তিনবার।
সৌরভ গুহ
দুয়ারে দফতর। সাধন পাণ্ডের প্রশাসনিক সাফল্য বুঝতে গেলে এই বিষয়টা বুঝতে হবে সবার আগে। দু’হাজার এগারো। সবে মাত্র ক্ষমতায় এসেছে মমতার সরকার। তখনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দুয়ারে সরকার’ চালু করেননি। বিজ্ঞাপনের দৌলতে তা মুখে মুখেও ফেরেনি। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন সদ্য কিডনি বিকল হয়েও লড়াই করে জেতা “অসুস্থ” সাধন পাণ্ডে। আর দফতর পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই অত্যন্ত নিষ্প্রভ, প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা ক্রেতা সুরক্ষা দফতরকে পাড়ায় পাড়ায়, দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিলেন সাধন পাণ্ডে। সেই প্রথম মানুষ দেখল, ক্রেতা সুরক্ষা বলেও একটা দফতর আছে , আর তা কাজও করে। চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুনকে হাতিয়ার করে হোর্ডিং ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল কলকাতা শহর। প্রতি ব্যানারেই বার্তা, সব ক্রেতার পাশেই আছে ক্রেতা সুরক্ষা দফতর। এই ছিল সাধনের ‘অসাধ্য সাধন’।
২০১১ সালে মানিকতলা বিধানসভা থেকে দাঁড়ান সাধন। সে বছরই কিডনি বিকল হয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে এসি গাড়িতে বিধানসভা ভোটে প্রচার সারেন। বড়জোর কোনও বৈঠকী সভায় একটু গাড়ি থেকে নামেন। ব্যস, ওই টুকুই। বিরোধী বাম শিবির তো ধরেই নিল , এই যদি প্রচারের হাল হয়, তবে তো সাধনের হার নিশ্চিত। কিন্তু ফলাফল হল উল্টো। আবারও জয়ী সেই সাধনই। এই জয়ের রহস্য ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সংযোগ। নেতা না, অসুস্থ অভিভাবককে জেতাতে সেদিন মরিয়া ছিলেন মানিকতলার বহু বাসিন্দা। বিশেষত নিম্নবিত্ত। সাধনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। রাজনীতি তো পরে।
জন্মাষ্টমীতে মানিকতলার বস্তি সাজো সাজো রব। রঙিন কাগজের মালায় সাজানো চারপাশ। সাধনবাবু এলেন। সঙ্গে গাড়ি ভর্তি লাড্ডুর প্যাকেট। মাইকে সামান্য দু’এক কথা বলেই মঞ্চ থেকে নেমে পড়লেন তিনি। আর কথা না, এবার মিষ্টি মুখ। এক স্বেচ্ছাসেবক বললেন, “দাদা, মিষ্টিগুলো বিলি করে দিই।” কথাটা শুনে ঘাড় ঘোরালেন সাধন। বললেন, “মিষ্টি আনলাম আমি আর বিলাবি তুই , এত তাড়া কিসের।” দাদার কথা শুনে অনুগামী অপ্রস্তুত। দেহরক্ষীকে চোখের ইশারায় সাধন জানালেন, “প্যাকেটগুলো নিয়ে পেছন পেছন এসো।” সাধন চললেন ভিড়ের মাঝে। নিজের হাতে লাড্ডু তুলে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে কারোর গাল টিপে বলছেন, “কী রে ভাল আছিস তো, আবার কারোর উদ্দেশে সাধনের বার্তা,”অন্য কোনওদিন বাড়ি আসিস, কথা বলব”। একজন কাতরস্বরে বলল, “দাদা, আমার কেএমডি-এর পায়খানা তো এখনও পেলাম না?” শুনে ঠোঁট চেপে সেই পরিচিত হাসি হেসে সাধনের সমাধান, “পায়খানা পেয়ে যাবি , এখন মিষ্টি খা”। এরপর সমবেত জনতার উদ্দেশে বলে উঠলেন, “হরে কৃষ্ণ , হরে কৃষ্ণ”। এহেন রাজনীতিক অলক্ষ্যেই দাদা-অভিভাবক হয়ে ওঠেন এলাকার। তাই ভোট এলে ভাষণ না দিলেও চলে। ২০১১-তে এই ঘটনাটাই ঘটেছিল। রাজনীতির অঙ্ক দিয়ে এই সম্পর্কের রহস্যভেদ করা কঠিন।
সাধন পাণ্ডে মানেই রাজনীতি আর সম্পর্ক বিজ্ঞানের মিশেল। নয়ের দশকের শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রদেশ কংগ্রেস কার্যত দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। কে কোন দিকে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। কেউ মমতা, কেউ বা সোমেন। মুখোমুখি দু’পক্ষ। এমন ঝঞ্ঝা বিধ্বস্থ সময়ে শ্যামবাজারে মিটিং ডাকলেন সাধন পাণ্ডে। সবার উৎকণ্ঠা, ইনি আবার কোন পক্ষে যান, সেটাই দেখার। সভায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর লোক। চারদিকে ফিসফাস, হয়তো আজই স্পষ্ট হয় যাবে সাধন কোন দিকে? সেদিনই সবাইকে চমকে দিয়ে সেই বিখ্যাত ভাষণ রেখেছিলেন সাধন। তাঁর বিখ্যাত ডায়লগ, “কংগ্রেস আমার মা, মমতা আমার বোন।” নাও, এবার তুমি বুঝে নাও, উনি কোন দিকে আছেন। এমন খেলা সাধনই পারতেন খেলতে।
সাধন অনুগামীদের সঙ্গে শশী পাঁজা, পরেশ পালদের আদায় কাঁচ কলায় সম্পর্ক। দলের সব বৈঠকে নিয়ম করে এ নিয়ে নালিশ। হুইপ জারি হল, অন্যের বিধানসভা এলাকায় না জানিয়ে কোনও কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারবেন না কেউ। খুব ভাল কথা, হুইপ জারি হয়েছে, তাতে সাধনকে কে রুখবে? রাজনৈতিক কর্মসূচি করা যাবে না, এই তো! শ্রাদ্ধ বাড়ি, বিয়ে বাড়ি যেতে তো মানা নেই। ক্লাবের স্বাধীনতা দিবস পালনে যেতে তো বাধা নেই। সুতরাং এক ঝুড়ি গোলাপ ফুল নিয়ে সাধন চললেন শশী পাঁজার বিধানসভা এলাকায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শ্রদ্ধা জানাতে। সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলেন, “নিজের এলাকা ছেড়ে, ওনার এলাকায় গেলেন কেন?” প্রশ্ন শুনেই গলা সপ্তমে চড়ালেন সাধন। কতকটা বাজখাই গলায় সাধনের জবাব, “কী বলতে চাইছো তোমরা, আমরা উত্তর কলকাতার লোক। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে পারব না। অনুষ্ঠান বাড়ি যেতে পারব না। তার জন্য অনুমতি লাগবে? জানো, আমাকে ইন্দিরা গান্ধী কী বলেছিলেন?
-যাক্, ছাড়ো, (এবার নীচু স্বরে) তোমাদের কাজ নেই, ফালতু কথা নিয়ে থাকো। পলিটিক্যাল প্রশ্ন করো না? কেন্দ্রীয় রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করো না
সাংবাদিকরা বললেন, “কেন্দ্রীয় রাজনীতি?”
সাধন বললেন, “আলবৎ।”
উৎসুক সাংবাদিকদের প্রশ্ন, “মানে কী রকম বলুন”
-আরে বাবা (ফিসফিসিয়ে বললেন) মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব মিটে যেতে পারে।
-কীভাবে? কিছু আপডেট ? (সাংবাদিকরা তুমুল উত্তেজিত )
-কথা বলতে হবে দশ জনপথে, বোঝাতে হবে মমতার বিকল্প নেই।
-সে তো হল, কিন্তু বোঝাবে কে?
প্রশ্ন শুনেই খানিকটা ঝুঁকে পরে তিনি বললেন, “কেন আমি! আমাকে দল দায়িত্ব দিক না, আমি বোঝাবো সোনিয়াকে। তোমরা সে দিনের ছেলেপুলে, কী জানো ইন্দিরাজী আমাকে কত স্নেহ করতেন।” বলেই চোখ টিপে সেই রগুরে হাসিটা হাসলেন পান্ডেজী ।
এই ইন্দিরা গান্ধী নিয়ে একটা চাপা প্রতিযোগিতা ছিল দুই জামাইয়ের। কে বেশি ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ? এ নিয়ে শ্রী মানী বাড়ির দুই জামাই সাধন পাণ্ডে আর সুব্রত মুখার্জির একটা চাপা লড়াই ছিল। সত্তরের দশকে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা তারকা রাজনীতিক সুব্রত মুখার্জির বিয়ে হয় উত্তর কলকাতার বারাণসী ঘোষ লেনের শ্রী মানি বাড়িতে। এই বাড়িতে এসেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ। আর শ্রী মানিদের আর এক শরিক কলেজ স্ট্রিটের শ্রী মানিদের জামাই সাধন। এটুকু যোগ ছাড়া রাজনীতির পথে সুব্রতর সঙ্গে সাধনের আর কোনো তুলনা হয় না। তুলনা কেউ করতো না। ব্যতিক্রম শুধু ইন্দিরা প্রসঙ্গ। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শুধু সুব্রত মুখার্জি না, তাঁর ও সম্পর্ক যে কিছু কম ছিল না, সেটা বোঝাতে কখনও কসুর করতেন না সাধন পাণ্ডে।
আরও পড়ুন : Sadhan Pandey Death : ‘রাজনীতির বাইরে আমাদের ভাল সম্পর্ক ছিল’, সাধন প্রয়াণে সমবেদনা জানিয়ে টুইট জগদীপের