অঞ্জন রায়
কলকাতা : সেক্রেটারিয়েট টেবিল থেকে সামনে রাখা চারটে চেয়ার, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রচুর বই। ইতিউতি উঁকি মারছে প্রচুর কাগজ-দস্তাবেজ। কোনও কোনও বইয়ের গায়ে লেগে ধুলো। গোটা কার্যালয়েই যেন একটা ব্যস্ততার ছবি। যেন তন্নতন্ন করে কিছুর একটা খোঁজ চলছে। কয়েকজন কর্মীও হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন এদিক ওদিক। মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। কী হল মুরুলীধর সেন রোডে রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে? প্রশ্ন করতেই সাংবাদিক জানতে পারলেন একটি বইয়ের খোঁজ চলছে। হন্যে হয়ে ওই বইয়ের খোঁজ করছেন বিজেপি নেতারা। কী বই? এই বই নাকি মুকুল রায় প্রণীত। তবে মুকুল রায়ের বই রয়েছে এমনটা তো শোনা যায়নি আগে! আরও একবার কৌতূহলী প্রশ্ন করতেই স্পষ্ট হল বিষয়টি। শোনা গেল, বই বললেও সেটা অবশ্য কোনও লেখকের লেখা নয়। বেশ কিছু তথ্যের সংকলন। আর ওই তথ্যগুলি এক জায়গায় এনে যিনি বইয়ের আকারে তৈরি করেছিলেন, তিনি খাতায় কলমে এখনও বিজেপির বিধায়ক (BJP MLA)। তবু তাঁর কাছ থেকে ওই বই চাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, গত বছরই সপুত্র তৃণমূল ভবনে জোড়াফুলের পতাকা পুনরায় হাতে নিতে দেখা যায় তাঁকে। আর সেই তিনি হলেন মুকুল রায়। তাই, জোরকদমে ওই বইয়ের খোঁজ চালাচ্ছে গেরুয়া শিবির।
কী রয়েছে ওই বইতে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে বর্তমানে মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে। সূত্রের খবর, মুকুলের ওই বইতেই রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সম্পত্তির খতিয়ান। এদিকে ইতিমধ্যেই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তির হিসাব জমা দিতে বলেছে আদালত। সূত্রের খবর, ঠিক সে জন্যই এবার জোরদার খোঁজ চলছে মুকুল রায়ের বইটির। সূত্র আরও জানাচ্ছে, বইটি তৈরির জন্য একটি পেশাদার সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছিলেন মুকুল রায়। সেসময় তৈরি হয়েছিল একটা টিম। তাঁদের তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল গোটা কাজ। বইতে নাকি ছিল মমতার পরিবারের ১২০০ কোটি টাকার খতিয়ান।
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তির হিসেব চেয়ে আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি। তাঁর সাফ দাবি, ২০১১ সালের পর থেকে মমতার পরিবারের সম্পত্তি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্রের খবর, এই জনস্বার্থ মামলায় ইডি, সিবিআই ও আয়কর দফতরকে দিয়ে তদন্ত করারও আবেদন জানানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে মমতার ভ্রাতৃবধূ তথা কলকাতা পুরনিগমের অন্যতম কাউন্সিলর কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আয়ের উৎস নিয়ে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরই একাধিকবার বিশ্ব বাংলার লোগো, তার মালিকানা, এবং লোগোর সরকারি বৈধতা নিয়ে একাধিকবার রাজনৈতিক মঞ্চে প্রশ্ন তোলেন মুকুল। জানা যাচ্ছে সেসময়েই দিল্লি গিয়ে তদানন্তীন বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত শাহ এবং তৎকালীন বঙ্গ বিজেপির পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তির খতিয়ান সম্বলিত ওই পুস্তিকা দেন মুকুল রায়। তবে বঙ্গ বিজেপির কোনও নেতা সেসময় মুকুলের কাছ থেকে পাননি। কারণ নাকি ওই সময় বঙ্গ বিজেপিতে মুকুলের তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আর তাই বইটি পাওয়ার জন্য তেমন কেউ আগ্রহও প্রকাশ করেননি। কিন্তু, এখন দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেস, এবং তার নেত্রীর পরিবারের সম্পত্তি বৃদ্ধির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলা আদালতে গৃহীত হওয়ার পর এমন একটি ‘দলিল’ (মুকুলের সেই বই) বিজেপির জন্য রাজনৈতিক কারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
কিন্তু, যতই প্রয়োজন হোক এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই গ্রন্থ। বুধবার বিজেপির এক প্রাক্তন বিধায়ক তথা রাজ্যের এক প্রথমসারির নেতা সরাসরি জানিয়ে দেন “আমি তো বইটা খুঁজে চলেছি”। এই খোঁজ শেষে সেই বই হস্তগত হয়ে পদ্ম শিবিরের সুবিধার্থে কাজে লাগবে কিনা তার উত্তর দেবে আগামী। তবে সাম্প্রতিককালে অসুস্থতার কারণে রাজনীতির অঙ্গন থেকে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া মুকুল রায় যে পুনরায় একরকন প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।