কোচবিহার: রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ঊর্ধ্বে গিয়েও ব্যক্তিগত সুসম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রাজ্যের বর্ষীয়ান এই মন্ত্রীর প্রয়াণের পর বার বার সে কথাই শোনা গেল বাম-বিজেপি-কংগ্রেস নেতাদের মুখে। সকলেরই সুব্রতবাবুর সঙ্গে মধুর স্মৃতি রয়ে গিয়েছে। তাঁর চলে যাওয়ার পর ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসছে সেই সব কথাই। বিজেপি বিধায়ক মিহির গোস্বামী। এক সময় তৃণমূল করলেও বর্তমানে বিজেপিতে। তবে দল বদলের পরও সৌজন্যে যে বদল আসেনি, ভাগ করে নিলেন সেই স্মৃতিই।
মিহির গোস্বামীর রাজনৈতিক জীবন শুরু ছাত্র রাজনীতি থেকেই। সাতের দশকে তখন তরুণ মিহির কলেজে পড়ছেন। সে সময় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ই মিহির গোস্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাজনীতির সহজপাঠ। মিহির গোস্বামী বলেন, “আগেই তো প্রিয়দা চলে গিয়ে আমাদের মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা যারা সাতের দশকে রাজনীতি করা তাদের সে ক্ষত এখনও টাটকা। বৃহস্পতিবার সুব্রতদাও চলে গেলেন। এটা আমার কাছে যেন বজ্রাঘাতের মতো মনে হল। বহু স্মৃতি ওনার সঙ্গে। উনি নেই ভাবতেও পারছি না।”
মিহির গোস্বামীর কথায়, “কতবার সুব্রতদার বাড়ি গিয়েছি। বৌদির সঙ্গেও একটা পারিবারিক বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে। রাজনীতিতে আমি যেখানেই থাকি না কেন ছাত্র রাজনীতিতে প্রিয়দা ও সুব্রতদা আমার কাছে নক্ষত্র ছিলেন, আছেন, থাকবেন। সুব্রতদা কোনওদিনই রাজনীতির রং দিয়ে বিচার করতেন না।”
সে কথার রেশ টেনেই মিহির গোস্বামী শোনালেন একুশের ভোটে জেতার পর বিধানসভায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। মিহির গোস্বামীর কথায়, “এবার বিজেপির হয়ে জেতার পর যখন শপথ নিতে যাই সে সময় সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রোটেম স্পিকার। আমাকে দেখেই স্মিত হাসলেন। আমি শপথ নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। বললাম, ‘দাদা আমি কি আপনার আশীর্বাদ চাইতে পারি?’। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ঘুরিয়ে পা দু’টো বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘প্রণাম কর। তোকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করছি। তুই ভাল থাক, সুস্থ থাক। ভাল থাক। তুই আমার কাছে যে মিহির ছিলি, সেই মিহিরই আছিস’। এই স্নেহের পরশ রাজনীতিতে আজকের দিনে বিরল।”
ছয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে তখন কংগ্রেস ক্ষমতাসীন। ছাত্র পরিষদে তখন তরুণ তুর্কিদের মুখের সারি। ওদিকে আবার নকশাল আমল। বঙ্গ রাজনীতির সেই পটেই উদয় হল দুই নেতার। একজন এলেন দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থেকে। নাম প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। অপর জন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আদি বাড়ি বর্ধমানে হলেও সুব্রতর বড় হওয়া কলকাতার উপকন্ঠে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে।
প্রিয়রঞ্জন হলেন নেতা। সুব্রত হলেন প্রিয়কে একেবারে আষ্টেস্পৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ভ্রাতৃপ্রতিম। সে সময় সুব্রত মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়েন। রাজ্য ছাত্র পরিষদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সুব্রত আলাদা ভাবে নজরে পড়ে তাঁর। বেশ সম্ভাবনাময়। জেলায় জেলায় সুব্রত গেলেন ছাত্র পরিষদকে আলাদা অক্সিজেন জোগাতে। জেলার ছেলেরা কলকাতায় এসে থেকে রাজনীতি করছে। বেশির ভাগ সময়ই থাকছেন মহাজাতি সদনে। প্রান্তিক জেলায় ঘুরে চলছে সংগঠনের হয়ে জোর প্রচার। সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ায় শোকবিহ্বল তাঁর পুরনো সতীর্থরা।
আরও পড়ুন: সাদা তোয়ালেয় ঢাকা চেয়ার, টেবিলে খোলা খাতা, মাস্ক! সুব্রতহীন বালিগঞ্জের অফিসও থম মেরে