কমলেশ চৌধুরী: পুরী জেলার অস্তরঙে একদিনে বৃষ্টি হয়েছে ৫৩০ মিলিমিটার। সেপ্টেম্বরে যা বৃষ্টি হয়, তার দ্বিগুণের বেশি ঝরেছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। নেপথ্যে, বঙ্গোপসাগরের অতি গভীর নিম্নচাপ। একই দিনে গুজরাতের জুনাগড়ের বিসাবদরে বৃষ্টি হয়েছে ৩৪৭ মিলিমিটার। সেপ্টেম্বরের গড় বৃষ্টির তিন গুণ ঝরেছে মাত্র আট ঘণ্টাতেই। নেপথ্যে, গুজরাতের নিম্নচাপ।
শুধু এই দু’টি প্রবল বর্ষণের ঘটনাই নয়, চলতি বর্ষায় একের পর এক ‘আকাশভাঙা বৃষ্টি’র সাক্ষী দেশ। রাজধানী দিল্লিতে বর্ষার চার মাসে ৬৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। সোমবার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১১৪২ মিলিমিটার। ভাঙার পথে ১৯৭৫ সালের রেকর্ড। জুলাইয়ের শেষে ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়েছিল বাংলা। মেদিনীপুর শহরে ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছিল ৩৬৪ মিলিমিটার। গোটা মাসের বৃষ্টি। আলিপুরে ঝরেছিল ২২৬ মিলিমিটার। জুলাইয়ের অর্ধেকেরও বেশি বৃষ্টি দু’দিনেই। মধ্যপ্রদেশের শিবপুরীর কথাও ধরা যাক। অগস্টের প্রথম দু’দিন মিলিয়ে বৃষ্টি হয়েছিল ৭৬০ মিলিমিটার। দু’মাসের বৃষ্টি দু’দিনে। পশ্চিমঘাট পর্বতের জন্য মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বরে এমনিতেই বেশি বৃষ্টি হয়। জুলাইয়ের শেষাশেষি দু’দিন মিলিয়ে মহাবালেশ্বরে বৃষ্টি হয়েছিল ১০৮০ মিলিমিটার। এর মধ্যে একদিনেই ঝরেছে ৬০০ মিলিমিটার।
অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি। ঠিক এই প্রবণতা বাড়ার কথাই বারবার উঠে এসেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের আইপিসিসি রিপোর্টে। সাম্প্রতিক রিপোর্টেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানী-গবেষকরা। বলা হয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ ২০৩০-এর মধ্যে অর্ধেক করতে না-পারলে ২০৫০-এর মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের বড় বিপদ অপেক্ষা করে থাকবে। ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে অন্তত ২ মিটার। কিন্তু বর্ষার খ্যাপা চরিত্র বোঝাচ্ছে, ২০৫০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, এখনই যেন দুয়ারে ‘ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি’।
ইংল্যান্ডের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া গবেষক অক্ষয় দেওরাসের বক্তব্য, ‘কয়েকটি রাজ্য বা একটি মরসুমের বৃষ্টিপাতের ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি সম্পর্ক টানা যায় না। তবে এটাও ঠিক, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ফলাফলই হল, রেইনফল ভেরিয়েবিলিটি বা বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা বেড়ে যাওয়া।’
সোমবার যে দু’টি রাজ্য ভাসছে, দু’টিই বর্ষার ঘাটতি প্রায় খরার মুখে দাঁড়িয়েছিল। রবিবারও ওড়িশায় ঘাটতি ছিল ২৫ শতাংশের। গুজরাতে ৩০ শতাংশেরও বেশি। পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কল বলছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিপদ আমরা আশঙ্কা করছি, তার সঙ্গে এই দুই রাজ্যের অবস্থা একেবারে খাপ খেয়ে যায়। অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টি। তার পর টানা শুখা দশা। এতে চাষের লাভ হয় না। উল্টে ক্ষতি। দুর্যোগ-দুর্ভোগে আরও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।’
বাংলা বা কলকাতাও অনেকটা একই প্রবণতার সাক্ষী। জুন, জুলাইয়ে অতিবৃষ্টির পর সে ভাবে ভারী বৃষ্টিই হয়নি দক্ষিণবঙ্গ বা কলকাতায়। জুনে আলিপুরে বৃষ্টি হয়েছিল ৪০৫ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৫২৫ মিলিমিটার। অথচ, পরবর্তী প্রায় দেড় মাসে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ৩০৯ মিলিমিটার। কলকাতাবাসীর সমস্যা বলতে একটানা অস্বস্তিকর গরম। কিন্তু গ্রামে জলের অভাব টের পেতে শুরু করেছেন ধানচাষি। অথচ, পড়শি রাজ্যেই ধারাবর্ষণ। পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যখন হচ্ছে, একেবারে ঢেলে বৃষ্টি নামছে। যেমন, পুরীতে যা হয়েছে বা জুলাইয়ে মহাবালেশ্বরে যা হয়েছিল, এগুলিকে আমরা বলি ব্যতিক্রমী ভারী বর্ষণ।’
ব্যতিক্রমী ঘটনা বারবার হলে আর ব্যতিক্রমী থাকে না, নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ভারতকে সতর্ক করে আইপিসিসি বলেই রেখেছে, ১০ বছরে যে বৃষ্টি-বিপর্যয় বছরে একবার হত, তা দ্বিগুণ বাড়বে। খ্যাপা প্রকৃতির চোখরাঙানি সামলাতে প্রশাসন তৈরি তো?
আরও পড়ুন: কারও কান কাটা গিয়েছে, কারও গলা! এবার চিলের চিল চিৎকারে নামল কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা টিম!